
চীনের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক জোট সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)–এর শীর্ষ সম্মেলন আজ রবিবার থেকে উত্তর চীনের তিয়ানজিন শহরে শুরু হয়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যাভিত্তিক সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক এই জোটে এবার অংশ নিচ্ছেন ২০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা। কিন্তু বৈঠকের সব আলোচনার কেন্দ্রে শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তা নয়-ভাসছে আরও বড় এক প্রশ্ন? যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ আর ভারত–চীন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ।
একবিংশ শতাব্দীর নতুন কূটনৈতিক মঞ্চ:
২০০১ সালে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে যাত্রা শুরু করা সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) এখন আর কেবল সীমান্ত নিরাপত্তার ফোরাম নয়। দুই দশকে এটি হয়ে উঠেছে চীনের বিকল্প আন্তর্জাতিক কাঠামোর প্রতীক।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী নেতৃত্বের বাইরে সমান্তরাল এক প্ল্যাটফর্ম তৈরির লক্ষ্যেই বেইজিং ধাপে ধাপে এই জোটকে প্রসারিত করেছে। ভারত, পাকিস্তান, ইরানসহ নতুন সদস্যরা এসসিওকে এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূরাজনীতির এক বড় অঙ্গনে পরিণত করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি এবারের সম্মেলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। সাত বছর পর মুখোমুখি হচ্ছেন শি এবং মোদি। সীমান্ত সংঘর্ষের রক্তাক্ত স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করছে, যদিও গত বছর এক চুক্তিতে কিছুটা উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক আরোপ ভারতের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে, যা বেইজিং ও নয়াদিল্লিকে আপাতত কিছুটা কাছাকাছি এনেছে।
অনেকে বলছেন, এটি চীনের জন্য এক ধরনের সুযোগ—ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট যেমন কোয়াড থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে আনার। অন্যদিকে, ভারতও বুঝতে পারছে যে শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার ঝড় সামলাতে আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ভারত–চীন: দ্বন্দ্ব নাকি সহযোগিতা?
বিশেষ নজর থাকছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাক্ষাতে। সাত বছর পর এ দুই নেতা মুখোমুখি হচ্ছেন। ২০২০ সালে সীমান্ত সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা দুই দেশের সম্পর্ক এখনও ঠান্ডা হয়নি। তবে ওয়াশিংটনের নতুন শুল্ক চাপ ভারতের ওপর অস্বস্তি বাড়িয়েছে। এর সুযোগ নিচ্ছে বেইজিং—ভারতকে ধীরে ধীরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট কোয়াড থেকে দূরে সরানোর কৌশল হিসেবে। তবে ভারতও বুঝছে, আঞ্চলিক বাস্তবতায় একা থাকা সম্ভব নয়। ফলে আপাতদৃষ্টিতে ভারত–চীন সম্পর্কে সহযোগিতার নতুন পর্ব শুরু হতে পারে।
জটিল দ্বন্দ্বের টেবিল:
এই সম্মেলনে যে শুধু সহযোগিতার বার্তা থাকবে তা নয়। একই টেবিলে বসেছে বহু পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভারত-পাকিস্তান, সৌদি-ইরান, কিংবা মধ্য এশিয়া ও রাশিয়ার টানাপোড়েন। তবুও সবাই একমত একটি বিষয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নীতির বিরুদ্ধে যৌথ অবস্থান। ফলে সম্মেলনের শেষে সম্ভাব্য যৌথ ঘোষণায় “নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও বহুপাক্ষিকতা” শব্দ শোনা গেলেও তার আড়ালে লুকিয়ে থাকবে ওয়াশিংটনবিরোধী সুর।
সাফল্যের খোঁজে:
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসসিও সম্মেলনের মূল তাৎপর্য আসলে প্রতীকী। সব সদস্যকে এক টেবিলে বসানো এবং শেষ পর্যন্ত একটি যৌথ বিবৃতিতে পৌঁছানোই হবে সবচেয়ে বড় সাফল্য।
আর কূটনীতির আসল নাটক হবে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের বাইরে—২ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে। কে কাকে আলাদা করে সময় দেবেন, তার ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের দিকনির্দেশনা।
বিশ্বশক্তির ইমেজ নির্মাণ:
সম্মেলনের পর বেইজিংয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৮০ বছর উপলক্ষে বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজে আয়োজন করবে। সেখানে উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন থেকে শুরু করে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট যোগ দেবেন। ভারতের মোদি যদিও থাকার সম্ভাবনা কম। এত বড় সমাবেশ চীনের জন্য বড় সুযোগ নিজেদের “বিকল্প বিশ্বশক্তি” হিসেবে তুলে ধরার।
- মো. সাইদুর রহমান বাবু, স্পেশাল করোসপন্ডেন্টস, অধিকারপত্র
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: