odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 17th December 2025, ১৭th December ২০২৫
পুলিৎজারজয়ী পিটার আর. কান: ঢাকা ডায়েরির বন্ধু থেকে বৈশ্বিক গণমাধ্যম সাম্রাজ্যের অধিপতি

বন্ধু, তোমার ডায়েরি: একাত্তরে ঢাকায় পিটার আর. কান-এর চোখে জল ও আগুন

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ১৭ December ২০২৫ ১৪:০৬

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ১৭ December ২০২৫ ১৪:০৬

মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কলাম

১৯৭১ সালের রক্তাক্ত ডিসেম্বরের ঢাকায় পুলিৎজারজয়ী সাংবাদিক পিটার আর. কান-এর ‘ঢাকা ডায়েরি’ কীভাবে এক নির্যাতিত জাতির কান্না ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল—এই ফিচারে উঠে এসেছে এক বিদেশি বন্ধুর সাহস, মানবতা ও ইতিহাসে অমর হয়ে থাকা অবদান।

পিটার আর. কান। নামটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একাত্তরের রণাঙ্গনে বিদেশী বন্ধুত্বের এক জ্বলন্ত প্রতীক।বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি কেবল একজন সাংবাদিক নন, তিনি হলেন সেই বিদেশি বন্ধু যিনি যুদ্ধের বিভীষিকাময় দৃশ্যের নীরব সাক্ষী, যিনি জীবন বাজি রেখেছিলেন একটি নির্যাতিত জাতির কান্না ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন। পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী এই আমেরিকান সাংবাদিক, সম্পাদক ও ব্যবসায়ী, তাঁর 'ঢাকা ডায়েরি'র মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যখন চারদিকে কেবল মৃত্যু আর অনিশ্চয়তা, তখন প্রাচীর ভেঙেছেন, দূরত্ব ঘুচিয়েছেন। তাঁর এই কালজয়ী 'ঢাকা ডায়েরি', যা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এ প্রকাশিত হয়, তা শুধু তাঁর পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্তির পথ প্রশস্ত করেনি, বরং এটি পরিণত হয়েছে একাত্তরের শেষ মুহূর্তের অন্যতম প্রামাণ্য দলিলে। তাঁর বিবরণ এক করুণ ইতিহাসের জন্ম দেয়। পিটারের এই অবদানের জন্য তাঁকে আমরা আমাদের এই বিজয়ের মাসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

প্রিন্সটন থেকে এশিয়া: এক অনুসন্ধানী যাত্রা

পিটার আর. কান (Peter R. Kann)-এর জন্ম ১৯৪২ সালে, নিউ জার্সির প্রিন্সটনে এক ইহুদি পরিবারে। বাল্যকাল থেকেই সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর ছিল অদম্য আগ্রহ। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বেছে নেন বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যেখান থেকে তিনি সাংবাদিকতায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। হাতে কলম ও মনে জিজ্ঞাসা নিয়ে ১৯৬৩ সালে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন আমেরিকার অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা 'দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল'-এর সান ফ্রান্সিসকো ব্যুরোতে। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সালে তাঁকে এশিয়ার কেন্দ্র হংকং অফিসে বদলি করা হয়। শুরু হয় তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এশিয়া তখন উত্তাল—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংঘাত। কান শুধু হংকং-এর দায়িত্বেই সীমিত থাকেননি; তিনি ছিলেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ভিয়েতনামের রেসিডেন্ট রিপোর্টার এবং এশিয়ার অন্যান্য প্রধান ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করেন। এশিয়ার এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁকে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার এক কঠিন পাঠ দেয়, যা তাঁর পরবর্তী জীবন ও কর্মে ছাপ ফেলে।

একাত্তরের ঢাকা: যুদ্ধের নীরব সাক্ষী

১৯৭১ সাল। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কাভার করার জন্য পিটার আর. কান ঢাকায় আসেন। তখন পূর্ব পাকিস্তান কার্যত এক মৃত্যুপুরী, যেখানে একদিকে চলছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বর্বর গণহত্যা, অন্যদিকে চলছে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। ডিসেম্বরের শুরুতেই যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত রূপ নেয়, তখন কান হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অন্য বিদেশি সাংবাদিক ও কূটনীতিকদের সঙ্গে আশ্রয় নেন। কিন্তু চারদিকে শুরু হওয়া বোমাবর্ষণ আর সামরিক নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি কোনো রিপোর্ট বা খবর সরাসরি অফিসে পাঠাতে পারছিলেন না। ঠিক সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে কান তাঁর কলমকে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি শুরু করেন 'ঢাকা ডায়েরি' লেখা। প্রতিদিনের ভয়, আতঙ্ক, গুজব এবং ঢাকা শহরের দৃশ্যপট—সবই তিনি লিখে রাখতেন নিপুণভাবে।

তাঁকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করেছিল সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ। ৯ ডিসেম্বরের ডায়েরিতে তিনি লেখেন, বোমাবর্ষণে একটি এতিমখানায় দুই শতাধিক শিশুর মৃত্যুর মর্মান্তিক দৃশ্য। অন্যদিকে, পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের গুজব ও ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ছলনা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ১৩ ডিসেম্বরের ডায়েরিতে তিনি বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান ও সোভিয়েত নৌশক্তির মুখোমুখি হওয়ার মতো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের চিত্র তুলে ধরেন। তাঁর ডায়েরি যেন একাত্তরের ঢাকার নিঃশ্বাস, যেখানে জীবনের শেষ আশা এবং আসন্ন গণহত্যার ভয় পাশাপাশি অবস্থান করত। শেষ পর্যন্ত, তাঁর ডায়েরিটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয় ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এ। এটি আন্তর্জাতিক মহলে ঢাকার প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে এবং বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে শক্তিশালী করে। তাঁর এই সাহস ও নিষ্ঠার জন্য তিনি ১৯৭২ সালে সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ সম্মান পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন।

Listen the Memorial Folk Cinematic Rock Song (1971 Tribute) in English “Friend of Bangladesh – Peter R. Kann”

১৯৭১-এর অগ্নিগর্ভ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ: যখন কলম হলো প্রতিবাদের অস্ত্র

১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে যখন রক্তস্রোত মিশে যাচ্ছিল শীতলক্ষ্যার জলে, পিটার আর. কান তখন ঢাকায় কর্মরত। 'দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল'-এর পক্ষে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কাভার করতে এসে তিনি হয়ে ওঠেন এক অভূতপূর্ব ইতিহাসের ধারক। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ভয়াবহ। ৩ ডিসেম্বর, রাত ৮টা বাজার আগেই কানে আসে সেই দুঃসংবাদ—"যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে!" হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পরিণত হয় পশ্চিমা সাংবাদিক ও কূটনীতিকদের এক অনিশ্চিত আশ্রয়ে। টেলিগ্রাফ অফিস বন্ধ, রিপোর্ট পাঠানোর সুযোগ নেই। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই পিটার কান তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি শুরু করেন: দিনপঞ্জি লেখা। সরাসরি রিপোর্ট লেখার সুযোগ না পেয়ে তাঁর দিনপঞ্জি হয়ে ওঠে অন্ধকারের বিরুদ্ধে এক আলোর রেখা। পরে এই 'ঢাকা ডায়েরি' 'দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল'-এ প্রকাশিত হয়, যা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে এবং তাঁকে এনে দেয় ১৯৭২ সালের পুলিৎজার পুরস্কার।

ডায়েরির পাতা থেকে: আতঙ্ক, গুজব, আর মানবতা

পিটার আর. কান-এর দিনলিপি যেন একাত্তরের ঢাকা শহরের নিঃশ্বাস। প্রতিটি পাতায় ফুটে উঠেছে যুদ্ধ, আতঙ্ক, আর মানবিক বিপর্যয়ের কঠিন বাস্তবতা।

  • ইন্টারন্যাশনাল সেফ জোন—হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বন্দিদশা: ডিসেম্বরের সেই শেষ সপ্তাহে ঢাকার দাপ্তরিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, যা আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কর্তৃক 'ইন্টারন্যাশনাল সেফ জোন' বা 'নিরপেক্ষ অঞ্চল' হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল। পশ্চিমা কূটনীতিক, সাংবাদিক এবং বিদেশি নাগরিকদের ভিড়ে এই হোটেল হয়ে ওঠে একপ্রকার 'রাজনৈতিক জিম্মিখানা', যেখানে জীবন ও মৃত্যু উভয়ই ছিল অনিশ্চিত।
  • ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার: ডায়েরির পাতায় ফুটে ওঠে এক মিশ্র চিত্র। একদিকে কিছু আমেরিকান ব্যবসায়ী তখনও ক্রিসমাস শপিং বা ইনকাম-ট্যাক্স ফর্ম নিয়ে চিন্তিত—অসহায় আশাবাদ। অন্যদিকে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনিবার্য পতনের গুজব সর্বত্র। নিয়াজির পালিয়ে যাওয়ার খবরও ঘুরছে কানে কানে। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই কান দেখতে পান মানবিক বিপর্যয়ের চরমতম রূপ: আবাসিক এলাকায় বোমাবর্ষণ হওয়া একটি এতিমখানার ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করা হচ্ছে দুই শতাধিক ছোট ছোট দেহ। এটি ছিল এক চরম নির্মমতা। সন্ধ্যা নামতেই রেড ক্রস হোটেলে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা শুরু করে। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি অতিথিদের কাছে থাকা এই অস্ত্র বাজেয়াপ্তের পর টয়লেটে পাওয়া যায় বেশ কয়েক প্যাকেট বিস্ফোরক। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল তখন সামরিক সংঘাত, কূটনীতি এবং বেসামরিক আতঙ্কের এক অদ্ভুত মিলনক্ষেত্র।
  • ১০ ডিসেম্বর—বোমাবর্ষণের রহস্য ও নিয়াজির প্রত্যাবর্তন: শুক্রবার, ১০ ডিসেম্বর, ঢাকা শহরের আকাশ তখনও আতঙ্কে ভারি। বোমাবর্ষণ নিয়ে গুজব ডালপালা ছড়াচ্ছে। বাঙালিরা বিশ্বাস করছিল, এতিমখানা বা বেসামরিক এলাকায় এই বোমা হামলা ভারতের ওপর দায় চাপানোর জন্য পাকিস্তানি উড়োজাহাজ থেকেই করা হয়েছে। বিশ্বস্ত বিদেশি সূত্রের বরাত দিয়ে কান লেখেন, এগুলো ছিল প্রপেলার-চালিত উড়োজাহাজ থেকে ফেলা, যা নির্দেশ করে এটি ঠাণ্ডা মাথায় করা কাজ। দীর্ঘকাল ধরে যারা পাকিস্তানিদের গণহত্যা দেখে আসছেন, তাদের কাছে এমন কাজ যে পাকিস্তানিরাই করেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। ঐ দিনই নিয়াজির পালিয়ে যাওয়ার গুজব মিথ্যা প্রমাণিত হলো। তিনি হোটেলের গেটে এসে দেখা দিলেন, যদিও রেড ক্রসের বিধিনিষেধের কারণে তাঁকে অস্ত্র ছাড়া প্রবেশ করতে হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর, নারী ও শিশুদের উদ্ধার করার জন্য ২৪ ঘণ্টার অস্ত্রবিরতি কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
  • ১১ ডিসেম্বর— রাজনৈতিক জিম্মি ও আত্মসমর্পণের গোপন চেষ্টা: শনিবার, ১১ ডিসেম্বর। সকালে যুক্তরাষ্ট্র তথ্যকেন্দ্র (ইউসিস)-এ বিস্ফোরণ ঘটানো হলো। লাইব্রেরিয়ান জানালেন, আক্রমণকারীর জবান উর্দু, অর্থাৎ সে পশ্চিম পাকিস্তানি। এটি আবারও পশ্চিম পাকিস্তানি চক্রের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের দিকেই ইঙ্গিত করে। সারাদিনের সবচেয়ে বড় খবর ছিল, ডেপুটি মার্শাল ল' অ্যাডমিনিস্ট্রেটর রাও ফরমান আলী, পাকিস্তানি বাহিনীর অগোচরে, সৈন্যবাহিনীর শর্তযুক্ত আত্মসমর্পণের জন্য জাতিসংঘের সঙ্গে গোপন সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ভারত রাজনৈতিক কারণে কলকাতা থেকে এবং পাকিস্তানও রাজনৈতিক কারণেই ঢাকা থেকে উড়োজাহাজ ছাড়তে রাজি না হওয়ায়, আটকে পড়া বিদেশিরা নিজেদের রাজনৈতিক জিম্মি ভাবতে শুরু করেন। এই দিনেই আমেরিকান কনস্যুলেটের বিষণ্নতার কারণ হিসেবে কান উল্লেখ করেন: আমেরিকা হারতে যাওয়া পক্ষকে সমর্থন করায় তাদের কূটনৈতিক পরিণতি ভুগতে হবে। এক পশ্চিমা কূটনীতিকের ভাষায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি পুরো 'লেজে-গোবরে' করে ফেলেছে।
  • পূর্বেই ডায়েরিতে নিশ্চিত করা স্বাধীনতা —মুক্তি ও পলায়নের দৃশ্য: পিটার আর. কান-এর ডায়েরি, যা বিজয়ের ঠিক দু’দিন আগে প্রকাশিত হয়েছিল, তা নিশ্চিত করে দিয়েছিল যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল সময়ের অপেক্ষা। তাঁর কলমের শক্তিই একাত্তরের শেষ প্রহরে ঢাকা শহরের সত্যকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই বন্ধুত্বের ঋণ বাংলাদেশ কোনো দিন ভুলবে না। ১৬ ডিসেম্বর ভোরে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ মানতে হয়। ভারতীয় জেনারেল অরোরাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে যেখানে, সেই রিসেপশন লাইনের উপর দিয়েই ভোরের অন্ধকারে শুরু হয় উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের পলায়ন। ব্রিগেডিয়ার শের খানের হেলিকপ্টারে করে আকিয়াব পলায়নের বিবরণী থেকে জানা যায়, কীভাবে চরম অব্যবস্থাপনা এবং ইঞ্জিনের সমস্যার মুখে তাঁরা প্রাণ হাতে করে শত্রুর সীমানা পেরিয়ে আরাকান অরণ্যে জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হন। একদিকে পরাজিতদের অসম্মানজনক পলায়ন, অন্যদিকে বিকেল বেলায় ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে মুক্তি ও স্বাধীনতার রক্তঝরা বিজয়।

গণমাধ্যম সাম্রাজ্যের চূড়ায় আরোহণ

পুলিৎজার জয় পিটার আর. কান-এর কর্মজীবনকে এক নতুন উচ্চতা দেয়। ১৯৭৬ সালে তিনি দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এশিয়া-এর সম্পাদক ও প্রকাশক নিযুক্ত হন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। তিনি মূল দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাবের চূড়ান্তে পৌঁছান ১৯৯২ সাল থেকে। ১৯৯২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় পনেরো বছর পিটার আর. কান বিখ্যাত ডাউ জোন্স অ্যান্ড কোম্পানি-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (CEO) এবং চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ডাউ জোন্স অ্যান্ড কোম্পানির বৈশ্বিক প্রসারে তাঁর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। তাঁর নেতৃত্বেই ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল শুধুমাত্র আমেরিকার নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার এক শক্তিশালী মানদণ্ড হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি পরিচিতি পান।

সমালোচনার ঝড় ও অবসর

দীর্ঘ এবং প্রভাবশালী এই কর্মজীবনের শেষ দিকে পিটার কান কিছুটা সমালোচিতও হন। তাঁর নেতৃত্বে ডাউ জোন্স অ্যান্ড কোম্পানির বৈশ্বিক প্রভাব বাড়লেও, ২০০৬ সালের দিকে কোম্পানিটি আর্থিক ধসের মুখে পড়ে। বিশ্লেষকেরা এই আর্থিক ব্যর্থতার জন্য আংশিকভাবে কানকে দায়ী করেন। ফলস্বরূপ, ২০০৬ সালে তিনি ডাউ জোন্স অ্যান্ড কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক এবং বৈশ্বিক গণমাধ্যমের অভিজ্ঞ নেতা হিসেবে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের সাংবাদিকদের কাছে তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিতরণ করেন।

শেষ কথা: বন্ধুত্বের ঋণ

পিটার আর. কান-এর জীবন ও কর্ম দুটি ভিন্ন মেরুতে বিভক্ত: একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকার রাস্তায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য উদঘাটন করা এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক; অন্যদিকে, বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী প্রকাশনা সংস্থার প্রধান নির্বাহী। কিন্তু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা ডায়েরির মাধ্যমে তিনি যে বন্ধুত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সত্যিকার অর্থেই পিটার আর. কান সেই বিরল বিদেশি সাংবাদিকদের একজন, যিনি বিপদ উপেক্ষা করে সত্যের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা পূরণ করেছিলেন। তাঁর দিনপঞ্জির মাধ্যমে পৃথিবী জানতে পেরেছিল এক জাতির মুক্তির সংগ্রাম এবং সামরিক জান্তার বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে। বাঙালির দুঃসময়ে তাঁর কলমের তেজ ছিল একাত্তরের রণাঙ্গনে পাওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী নৈতিক সমর্থনের একটি। বন্ধু, তোমার ডায়েরি আমাদের স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী পথকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিল। সেই ঋণ আমরা কোনোদিন ভুলব না।

শুনুন স্মরণগাথা: বাংলাদেশের বন্ধু পিটার আর. কান (Folk Cinematic Memorial Song):

ঢাকার আকাশে বারুদের গন্ধ,
নিস্তব্ধ শহর, কাঁপে জীবন।
বিদেশি এক বন্ধুর চোখে ধরা পড়ে
একটি জাতির স্বাধীনতার মূল্য।

সেই বন্ধু, অকৃত্রিম, নির্বিক, ১৯৭১,
বাংলাদেশের বন্ধু পিটার আর. কান
অধিকারপত্র জানায় তোমায় হাজারো সালাম!

...

বিদেশি ছিলে,
কিন্তু হৃদয় ছিল বাংলার,
বন্ধু হয়ে থাকলে ইতিহাসে—
পিটার আর. কান,
বাংলাদেশ তোমায় ভুলিবে না আর।

মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

#পিটারআরকান #ঢাকাডায়েরি #একাত্তর  #মুক্তিযুদ্ধ #বাংলাদেশেরবন্ধু #PulitzerPrize #WarJournalism #Bangladesh1971 #ForeignFriend #LiberationWar #HistoryOfBangladesh #JournalismAndTruth #DhakaDiaries #HumanityInWar #GlobalMedia



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: