
বাঙালি সংস্কৃতি বলতে সাধারণত বোঝানো হয় বিশেষ সমাজের সাহিত্য, সংগীত, ললিত কলা, ক্রিড়া, মানবিকতা, জ্ঞানের উৎকর্ষ ও আরো অনেক শান্তি ও সৌন্দর্যের সমাহার। এর পরও, ব্যাপক দৃষ্টিতে দেখলে সংস্কৃতি হলো মানুষের জ্ঞান, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, নীতিবোধ, চিরাচরিত প্রথা, সমষ্টিগত মনোভাব, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং অর্জিত কীর্তিসমূহ। নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে সংস্কৃতি আবার ভিন্ন ধরনের একটি জটিল ধারণা। যেহেতু সব সংস্কৃতিই উৎস, বিকাশ, মূল্যবোধ এবং সংগঠনের দিক দিয়ে বিশিষ্ট, তাই বাহ্যিক রূপরেখা, তার বিবিধ প্রকাশ এবং নির্যাসে এক সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতি থেকে যথেষ্ঠ পৃথক। হাজার হাজার বছর ধরে নানা নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী ও শাখা-গোষ্ঠী, নানা শ্রেণির মিলন, পারস্পরিক প্রভাব এবং সমন্বয়ের ফলে গড়ে উঠেছে বঙ্গীয় সংস্কৃতি। বহু শতাব্দী ধরে সংস্কৃতির বিভিন্ন, এমনকি, পরস্পর-বিরোধী উপাদানের সহাবস্থান এবং সমন্বয়ের ফলে বঙ্গীয় অঞ্চলে বাঙালিত্বের এমন এক বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে যাকে বলা যায় বঙ্গীয় সংস্কৃতি এবং এক কথায় বলা যায় বঙ্গদেশ ও বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি।
বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তি বঙ্গীয় সংস্কৃতি যেহেতু বাংলাদেশ এবং বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি, সে কারণে ‘বাঙ্গালা’ নামে একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল গড়ে ওঠার আগে অথবা বাংলা ভাষা পুরোপুরি বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করার আগেকার আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে বাঙালি সংস্কৃতি বলে অন্তত তত্ত্বগতভাবে আখ্যায়িত করা যায় না। আবার এও স্বীকার্য যে, সুলতানি আমলের বাঙ্গালা রাজ্য অথবা বাংলা ভাষা গড়ে ওঠার মুহূর্ত থেকে বাঙালি সংস্কৃতির জন্ম হয়নি। বঙ্গীয় সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে উঠেছিলো আরো অনেক আগে থেকে।
বাঙ্গালা নামে পরিচিত এই বিরাট এলাকায় ছিলো অনেকগুলি রাজ্য-গৌড়, রাঢ়, দক্ষিণ রাঢ়, সুহ্ম, বরেন্দ্রী, হরিকেল, সমতট এবং বঙ্গ। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে আরও ছোটোখাটো রাজ্য ছিল। ১৩৫০-এর দশকে গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ জয় করে ‘শাহ-ই বাঙালিয়ান’ অর্থাৎ বাঙালিদের শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। বৃহত্তর ‘বাঙ্গালা’র জন্ম তার আগে হয়নি। অন্য দিকে, বাংলা ভাষাও আবার মোটামুটি ওই সময়েই নিজের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে স্বতন্ত্র ভাষার রূপ লাভ করে। দুদিক থেকেই বিবেচনা করলে বঙ্গীয় সংস্কৃতির বয়স তাই আট শো অথবা বড় জোর এক হাজার বছর। এর চেয়ে একে পুরানো বলে গণ্য করা যায় না। কিন্তু এই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলের হাজার হাজার বছরের পুরানো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে। একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় যে, খাদ্যাভ্যাসের কারণে বাঙালিদের নাম ‘ভেতো’ বাঙালি। আর্য অথবা মুসলমানরা এ দেশে ধান আনেননি, ধানের চাষ এ অঞ্চলে আরম্ভ হয়েছিল অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগে। পরে কখনো আর্য, কখনো সেন, কখনো তুর্কি, কখনো আফগান, কখনো মোগল এবং সবশেষে ইংরেজরা বঙ্গভূমি দখল করেছেন, তবু বাঙালিদের ভাত খাওয়ার অভ্যাসে পরিবর্তন হয়নি। ভাত বাঙ্গালীর একটি সাংস্কৃতিক ভিত্তি।
বঙ্গীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যের কারণ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে যথেষ্ট মিল থাকলেও, বঙ্গভূমির ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং বিবিধ নৃতাত্ত্বিক সংমিশ্রণের ফলে এর সংস্কৃতি নিজস্বতা লাভ করেছে। এর অবস্থান দীর্ঘদিনের শাসনকেন্দ্র দিল্লি থেকে শত শত মাইল দূরে ভারতীয় উপমহাদেশের একেবারে এক প্রান্তে। ধর্ম, দর্শন ও ধারণা, সাংস্কৃতিক ধারা ও শাসনকাঠামো - যা কিছু এই প্রান্তিক ভূখন্ডে এসে পৌঁছেছে, তা-ই অল্পকালের মধ্যে বঙ্গীয় চরিত্র দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। তদুপরি জালের মতো বিস্তৃত নদী-শাখা নদী এবং বনভূমি-পরিপূর্ণ বঙ্গদেশ আবার বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, ফলে এসব অঞ্চলেও সংস্কৃতি খানিকটা স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছেন। এসব উপ-সংস্কৃতিও জাতি, ধর্ম, বর্ণ, এবং বহু উপভাষার কারণে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।
বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন এবং ইসলাম ধর্মের মতো প্রধান প্রধান ধর্মের উৎপত্তি-স্থান থেকে বঙ্গভূমি বহু দূরে অবস্থিত, সে কারণে এই সব ধর্মের কোনোটাই তার আদি এবং অকৃত্রিম রূপে এ অঞ্চলে পৌঁছায়নি। তদুপরি, এসব বহিরাগত ধর্মের সঙ্গে স্থানীয় ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচারের সমন্বয় ঘটেছে। এভাবে বঙ্গদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং ইসলাম ধর্ম যেমন বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, তেমনি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং সামাজিক রীতিনীতির কিছু মিল লক্ষ করা যায়। সপ্তম শতাব্দীতে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং লিখেছেন যে, তিনি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী স্থানীয় লোকদের ধর্মীয় দর্শন, আচার-আচরণ এবং সামাজিক রীতিনীতিতে অনেক সাদৃশ্য দেখেছেন। তিনি আরও লক্ষ করেন যে, বঙ্গীয় বৌদ্ধধর্ম মূল বৌদ্ধধর্ম থেকে অনেকটাই আলাদা।
বসতি এবং নৃতত্ত্ব পশ্চিম, উত্তর এবং মধ্যবঙ্গের তুলনামূকভাবে উঁচু এলাকা ছাড়া প্রাচীন বঙ্গভূমির অন্যান্য এলাকায় লোকবসতি ছিল খুব কম। মনে হয়, এখন যেমন জনবসতির একক হিসেবে হাজার হাজার গ্রাম গড়ে উঠেছে, সুলতানি আমলের আগে তা তেমন সংখ্যায় গড়ে ওঠেনি। দশম শতাব্দী থেকে রচিত বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদে গ্রামের কোনো উল্লেখ নেই। নিরাপত্তা এবং উৎপাদনের জন্যে লোকেরা তখন বোধ হয় ‘পুরী’ এবং ‘নগরে’ বাস করতেন। বসতির এই বৈশিষ্ট্য উপ-নাগরিক সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সম্ভবত প্রধান কারণ ছিল। আর নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বেশির ভাগ বাঙালিই অস্ট্রো-এশিয়াটিক, কিন্তু দ্রাবিড় গোষ্ঠীও এর মধ্যে মিশিছে। এই দুটি প্রধান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ছাড়া, বাঙালিদের মধ্যে তিববতী-চীনা এবং সেমেটিক রক্তেরও সংমিশ্রণ ঘটেছে।
সামাজিক গঠন বাঙালি সমাজ আগাগোড়াই পিতৃতান্ত্রিক এবং সোপানভিত্তিক। আর্যরা বঙ্গদেশে আসার আগে পর্যন্ত সামাজিক কাঠামো ঠিক কেমন ছিলো, তা জানা না-গেলেও, প্রাক-আর্যযুগে জাতিভেদ প্রথা ছিলো বলে মনে হয় না। অপর পক্ষে, আর্যরা যে বৈদিক ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন, তাতে জাতিভেদ এবং বর্ণভেদ অনুযায়ী গোটা সমাজ চারটি স্তরে বিন্যস্ত ছিলো। এগুলো হলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। ব্রাহ্মণদের সংখ্যা কম হলেও, তাঁরাই ছিলেন সমাজে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় এবং প্রভাবশালী; আর সমাজের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ - শূদ্ররা ছিলেন সবচেয়ে নিচের তলায় অবস্থিত এবং সবচেয়ে অবহেলিত ও শোষিত। দারুণ বৈষম্যকারী এই বর্ণভেদ প্রথা কেবল ধর্মের দিক দিয়েই বৈষম্য সৃষ্টি করেনি, বরং এ ছিল সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের ধর্মের বিধিবদ্ধ স্থায়ী ব্যবস্থা। বর্ণভেদ প্রথা কার্যত শ্রেণিভেদ প্রথা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তা সত্ত্বেও জাতিভেদ-প্রথা সমাজের নিচের তলার লোকেরা নিজেদের মধ্যে কঠোরভাবে পালন করতেন না।
জাতিভেদ প্রথা বর্ণভেদেরই বহিঃপ্রকাশ। এই প্রথা অনুযায়ী শূদ্ররা অস্পৃশ্য। ক্ষত্রিয়দের সংখ্যা বঙ্গদেশে খুব কম ছিল। বৈশ্য এবং অন্য কোনো কোনো গোষ্ঠীর হিন্দুদের দিয়ে পরে তৈরি হয় কায়স্থ সম্প্রদায়। এ ছাড়া, বৈদ্য সম্প্রদায় হলেন চিকিৎসা পেশার সঙ্গে জড়িত। তত্ত্বগতভাবে বৌদ্ধ এবং মুসলমানদের মধ্যে কোনো জাতিভেদ প্রথা থাকার কথা নয়, কিন্তু বঙ্গদেশে এসে তাঁরাও এই প্রথা দিয়ে প্রভাবিত হন এবং এক ধরনের জাতিভেদ প্রথার মধ্যে পড়ে যান। সেনরাজাদের সময়ে বৌদ্ধরা শ্রেণিভুক্ত হন শূদ্র হিসেবে এবং তাঁদের বলা হতো ‘নেড়া’ (মাথা মোড়ানো)। মুসলমানরা আসার পর বর্ণহিন্দুরা সাধারণ মুসলমানদেরও গণ্য করতেন শূদ্রদের মতো। মুসলমানরা নিজেরা তাঁদের সমাজকে বিভক্ত করেন আশরাফ এবং আতরাফ এই দুই ভাগে। আতরাফ ছিলেন প্রধানত দেশীয় এবং নিম্নশ্রেণির মুসলমানরা। এই শ্রেণিভেদ প্রথা দিয়ে মুসলমানরা এতোটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তাঁরা মসজিদেও এটা বজায় রাখেন, সেখানে সুলতান এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের জন্যে থাকতো উঁচু আসন। এ ছাড়া, আশরাফ এবং আতরাফদের মধ্যে বিবাহ হতো না, অথবা তাঁরা একত্রে ভোজনও করতেন না। বঙ্গসমাজের শতকরা আশি ভাগ অথবা তারও বেশি শূদ্র এবং গ্রামের মুসলমান। তাঁরাই ছিলেন উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি জড়িত - চাষী, শ্রমিক এবং নাপিত, জেলে, ছুতোর এবং জোলাদের মতো পেশাদার দক্ষ শ্রমিক।
মধ্যযুগে পরিবারগুলো একক পরিবার ছিল না, যদিও পরিবারের আয়তন ছিলো ছোট। উনিশ শতকের গোড়া থেকে হিন্দুদের মধ্যে একান্নবর্তী পরিবার গড়ে উঠতে থাকে বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং ছোট-বড় জমিদার পরিবারে। জমির মালিকদের মধ্যে এই প্রথা সম্ভবত গড়ে উঠেছিল ১৭৯৩ সালে প্রণীত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্যতম ফলাফল হিসেবে।
ধর্ম এবং বিশ্বাস খ্রিস্টের জন্মের কয়েক শতাব্দী আগে মোটামুটি একই সময়ে বৈদিক এবং বৌদ্ধধর্ম বঙ্গদেশে পৌছেছিল। তারপর এই দুই ধর্ম স্থানীয় ধর্ম ও বিশ্বাসসমূহকে প্রভাবিত করে। চন্দ্রকেতুগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক ভগ্নাবশেষ থেকে মনে হয় হিন্দু রাজারা দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গ অর্থাৎ দক্ষিণ রাঢ়ে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়/দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে নিজেদের বেশ শক্ত ভিত্তির ওপর স্থাপিত করেন। অপরপক্ষে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে গড়ে ওঠা মহাস্থানগড়ের ভগ্নাবশেষ দেখে মনে হয় বৌদ্ধরা তখনই পুন্ড্রবর্ধন অর্থাৎ উত্তরবঙ্গে বেশ বড়ো রকমের বসতি স্থাপন করেছিলেন। এই দুই ধর্ম এতো প্রবল ছিল যে, এদের প্রভাবে স্থানীয় ধর্মগুলো ধীরে ধীরে প্রায় লোপ পায়। তবে এই দুই ধর্মকেও স্থানীয় ধর্ম এবং আচার-আচারণ যথেষ্ট প্রভাবিত করে। যেমন, বৈদিক ধর্মে স্থানীয় অনেক দেবদেবী ঢুকে পড়েন, যাঁদের অস্তিত্ব মূল বৈদিক ধর্মে ছিল না।
বঙ্গদেশের সবচেয়ে পুরানো যে রাজার কথা নিশ্চিতভাবে জানা যায়, তাঁর নাম শশাঙ্ক। সপ্তম শতাব্দীর এই রাজা ছিলেন হিন্দু। অপর পক্ষে, বৌদ্ধ পাল-রাজাদের রাজত্ব আরম্ভ হয় পরের শতাব্দীতে। শশাঙ্ক কেবল হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না, তিনি বৌদ্ধদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন। পাল রাজারা কয়েক শতাব্দী ধরে বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষণা করলেও, হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। পালদের পর যে সেন বংশ ক্ষমতায় বসেন, তাঁরা ছিলেন হিন্দুধর্মের উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক। বৌদ্ধরা তাঁদের আমলে নির্যাতিত হয়েছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। তাঁদের শাসনকালে বৌদ্ধ ধর্ম তার গৌরব হারায় এবং বৌদ্ধদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পায়। সেনরা, তদুপরি, বর্ণভেদ প্রথাকে কঠোরভাবে প্রচলিত করেন এবং সংস্কৃত শাস্ত্র ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষণা করেন।
১২০৪ সালে লক্ষ্মণসেনকে পরাজিত করে বখতিয়ার খলজী মুসলিম শাসন প্রবর্তন করলে পরিবর্তনের আরও একটা ঢেউ আসে। খলজীর পরপর বঙ্গভূমিতে এসেছিলেন অনেক মুসলমান ধর্মপ্রচারক। অংশত সুলতানের সহায়তা নিয়ে তাঁরা স্থানীয় লোকদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেওয়ার কাজ উৎসাহের সঙ্গে আরম্ভ করেন। প্রথম দুইশত বছরে ইসলামে দীক্ষা দেওয়ার কাজ কতোটা সাফল্য লাভ করেছিল, তা পরিষ্কার জানা না গেলেও এ সময়ে বৌদ্ধদের সংখ্যা খুবই হ্রাস পায় এবং হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সেনরা যে বর্ণভেদ প্রথা জোরালোভাবে চালু করেছিলেন, তার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশে বৌদ্ধরা একযোগে ইসলামে দীক্ষা নিয়েছিলেন কিনা, তা অনুমানের বিষয়। তাছাড়া, নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও ব্যাপক সংখ্যায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয়। শক্তি প্রয়োগ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেওয়ার বহু প্রমাণ থাকলেও, অন্তত তত্ত্বগতভাবে ইসলাম ধর্মে যে-সামাজিক সাম্যের কথা বলা হয়েছে, তা বহু সংখ্যক দীক্ষার কারণ হতে পারে।
এর পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে বঙ্গভূমিতে ইসলাম ধর্মের যথেষ্ট বিবর্তন হয়। পারস্য থেকে আসা পীর/দরবেশরা যে-ভক্তিবাদী ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিলেন, স্থানীয় লোকেরা তা দিয়ে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। অপরপক্ষে, আরব ধর্মপ্রচারকরা নিয়ে এসেছিলেন মৌলবাদী ইসলাম, যা স্থানীয় লোকেদের আকৃষ্ট করেনি। সতেরো শতক নাগাদ বঙ্গীয় ইসলাম আগেকার বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের মতোই একটা স্থানীয় সমন্বয়ী ধর্মের রূপ লাভ করে এবং সমাজের নিচের তলার লোকেরা এই বঙ্গীয় ইসলাম দিয়েই প্রভাবিত হন।
ইসলাম ধর্মের এই আক্রমণের মুখে হিন্দু ধর্মের মধ্যেও সংস্কার চলতে থাকে। যেমন, দেবীবর ঘটক হিন্দু ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশে বর্ণপ্রথার নিয়মগুলো আরও দৃঢ়ভাবে চালু করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সময়ের ধারা বইছিলো উল্টো খাতে। এই পরিস্থিতিতে ষোলো শতকের গোড়ায় চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) ভক্তি এবং প্রেমের আদর্শের ওপর স্থাপিত বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। যে জাতিভেদ প্রথা সমাজকে স্থায়ী শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিলো এবং যা ছিলো সামাজিক নির্যাতনের প্রধান হাতিয়ার, চৈতন্যদেব তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। এই ধর্ম কেবল হিন্দু ধর্মকে ইসলামের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেনি, বরং পরবর্তী দু শতাব্দী ধরে বৈষ্ণব ও সামগ্রিকভাবে হিন্দু ধর্মচর্চায় নতুন জোয়ার এনেছিল। তাছাড়া এর প্রভাবে সহজিয়া, বাউল এবং কর্তা-ভজার মতো ভক্তিবাদী সম্প্রদায়ও জন্ম দেয়। এসব সম্প্রদায় প্রথমেই জাতিভেদকে অস্বীকার করে। তদুপরি এরা বিধিবদ্ধ ধর্মের চেয়ে গুরুভক্তি এবং নামহীন এক দেবতার ভজনাকে গুরুত্ব দেয়। বঙ্গভূমির বিচিত্র ধর্মগুলোর মধ্যে যদি কোনো মিল থেকে থাকে, তা হলো এই গোঁড়ামিবর্জিত নমনীয়তা এবং সমন্বয়ধর্মী ভক্তিবাদ।
ভাষা বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অন্যতম ভাষা। এ ভাষা বঙ্গভূমির আদি ভাষা ছিল না। তখন বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত ছিলো। আর্যরা সঙ্গে নিয়ে আসেন পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃত ভাষা। বৌদ্ধরা এনেছিলেন পালি ভাষা, যা প্রাকৃতের মতো সংস্কৃত ভাষারই একটি মৌখিক রূপ। বহু শতাব্দী ধরে উচ্চারণ ও ব্যাকরণগত বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষা স্বতন্ত্র রূপ লাভ করে। এই ভাষার আদি রূপ খানিকটা পাওয়া যায় দশম শতাব্দী থেকে রচিত চর্যাপদে। তবে বাংলা ভাষা তখনও একেবারে আলাদা ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি, মিশে ছিলো অহমিয়া এবং ওড়িয়া ভাষার সঙ্গে। তাই সঠিকভাবে বললে বলতে হয়, চর্যাপদে যে-বাংলা দেখা যায়, তা প্রাক্-বাংলা। আনুমানিক পনেরো শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন খাঁটি বাংলা ভাষার আদিতম নিদর্শন। মধ্যযুগের অন্যান্য কাব্য থেকেও সেকালের ভাষার আভাস পাওয়া যায় - যদিও এসব কাব্যের আদি পাঠ পাওয়া যায় না। এসব কাব্যের যে পান্ডুলিপি এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, সেগুলো মূল কাব্য রচিত হওয়ার অনেককাল পরের প্রতিলিপি। অপরপক্ষে, সেকালের গদ্যের কোনো নমুনাই বলতে গেলে পাওয়া যায় না।
বাংলা ভাষা যেহেতু সংস্কৃত ভাষার মৌখিক রূপ প্রাকৃত থেকে উৎপন্ন, সে কারণে এ ভাষার শব্দাবলীর প্রধান ভাগই হয় সংস্কৃত, নয়তো সংস্কৃত শব্দের বিবর্তিত রূপ (যেমন চন্দ্র থেকে চাঁদ)। তবে এ অঞ্চলের আদি ভাষাগুলোর কিছু শব্দও বাংলায় রয়ে গেছে (যেমন চাউল, ঢেঁকি)। স্থানীয় ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্যও বহিরাগত বাংলাকে প্রভাবিত করেছে (যেমন, কোনো কোনো ক্রিয়া-বিভক্তিতে)। মুসলিম শাসন বাংলা ভাষাকে প্রভাবিত করেছিলো দুভাবে। প্রথমত, এ সময়ে বাংলা ভাষায় হাজার হাজার আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়ে। দ্বিতীয়ত, যে বাংলাকে সেনরা অবহেলা করেছেন এবং ব্রাহ্মণরা ঘৃণা করেছেন, সুলতানরা পনেরো শতক থেকে তারই পৃষ্ঠপোষণা করতে আরম্ভ করেন। সতেরো/আঠারো শতকে কিছু পর্তুগিজ শব্দও বাংলা ভাষায় এসে যায় (যেমন আনানাস)। বিদেশী ভাষার ঢেউ আর একবার বাংলা ভাষায় লাগে ব্রিটিশ রাজত্ব স্থাপিত হওয়ার পর। সেই সুবাদে এখন বাংলায় কয়েক হাজার ইংরেজি শব্দ প্রতিদিনের শব্দে পরিণত হয়েছে। বাক্য-গঠনে এবং যতিচিহ্নেও (যেমন কমা, সেমিকোলোন, আশ্চর্যবোধক চিহ্ন) ইংরেজির প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া, স্থানীয় ভাষা বাংলার চর্চা বাড়িয়ে আইন-আদালতের ভাষা ফারসিকে সরিয়ে দেওয়া যায় কিনা, তারও চেষ্টা ইংরেজ প্রশাসন করেছিল আঠারো শতকের শেষ কয়েক দশক ধরে। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যান্য দিকের মতো বাংলা ভাষাও নমনীয় এবং সমন্বয়ধর্মী। ছাপাখানা প্রবর্তিত হওয়ার পর এবং নতুন ধরনের লেখ্য সংস্কৃতির প্রভাবে আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বাংলা গদ্যচর্চা আগের তুলনায় অনেকটাই বৃদ্ধি পায়।
সাহিত্য চর্যাপদকে বাংলার নিদর্শন হিসেবে গণ্য করলে বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্যমন্ডিত ঐতিহ্য প্রায় হাজার বছরের। অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের মতো বাংলাও তার যাত্রা শুরু করেছিল ধর্মীয় কাব্য দিয়ে, আরও সঠিক করে বললে, ভক্তিবাদী গান দিয়ে। চর্যাপদ থেকে আরম্ভ করে মধ্যযুগের বিশাল সাহিত্যভান্ডার- এর প্রায় সবটাই হলো ঈশ্বরমুখী এবং এর মধ্যে ছিলো বৌদ্ধ, হিন্দু এবং মুসলমানদের ধর্মীয় সাহিত্য। ব্যতিক্রম দেখা যায় শাহ মুহাম্মদ সগীর, দৌলত কাজী এবং আলাওলের কিছু রোমান্টিক কাব্যে। হিন্দু কবিরা তাঁদের রোমান্টিক অনুভূতি, আবেগ এবং অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন রূপকের মাধ্যমে কেবল রাধাকৃষ্ণের প্রেমের কাহিনী নিয়ে রচিত বৈষ্ণব সাহিত্য। বস্ত্তত, উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত বাঙালি কবিরা তাঁদের নিজেদের ‘মনের কথা’ বলতে গেলে প্রকাশই করেননি।
মধ্যযুগে সুফিবাদের মতো ভক্তিবাদী দর্শনের উদ্ভব এবং বৈষ্ণব, সহজিয়া, বাউল, কর্তাভজা ও সখীভাবকের মতো ধর্মীয় সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করার পর সত্যপীর/সত্যনারায়ণ এবং দক্ষিণ রায়/বড় খান গাজীর মতো লৌকিক দেবতার দেখা মেলে। এবং সাহিত্যেও একটা সমন্বয়বাদী ধারার সৃষ্টি হয়। এই সাহিত্য ছিল বাঙালিত্বের ধারণাপুষ্ট। এ রকম এক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ ধর্ম এর আগে কখনও বঙ্গীয় সমাজে ছিল না। এই ক্রান্তিলগ্নে দেব-দেবীরাও মানুষের বেশে দেখা দিতে আরম্ভ করেন।
এরপর উনিশ শতকে ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবে বাঙালি কবি এবং লেখকরা মানবতা এবং নিজেদের ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতিকে তাঁদের লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন। এই নতুন সাহিত্য ঈশ্বরমুখী নয়, মানবমুখী। সাহিত্যের বিষয়বস্ত্ত এবং মূল ভাবধারাই এ সময়ে বদলে যায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটা একটা যুগান্তর। প্রকৃত পক্ষে, এই মানববাদী নতুন সাহিত্য দিয়েই বঙ্গীয় রেনেসাঁর সূচনা হয়। এতে বিরাট অবদান রেখেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূুদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হিন্দু পুরাণভিত্তিক সাহিত্য নতুন করে লেখার সময়ে প্রথম দুজন তাদের পুনর্ব্যাখ্যা দান করেন এবং এই পুরাণের দেবদেবীকে মানুষে পরিণত করেন; আর শেষের দুজন একই কাজ করেন, তবে একটু ভিন্ন রীতিতে।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষা-ব্যবস্থার বিকাশ এবং ছাপাখানার প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলা সাহিত্যে সৃজনশীলতার এমন স্ফূরণ ঘটে যে, যা এর আগে কখনো এমন ব্যাপকভাবে ঘটেনি। তবে এও সত্য যে, এই মুদ্রিত সাহিত্যের বিকাশ ঘটার ফলে মধ্যযুগে যে লোকসাহিত্য এবং মৌখিক সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিলো, সেই ধারা দ্রুত শুকিয়ে আসে। তদুপরি, হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে নাগরিক সাহিত্যের বিকাশ ঘটে অসমানভাবে, কারণ মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় ইংরেজি এবং বাংলা - উভয় শিক্ষায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন। তবে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে এই দু্ই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ কমে আসতে আরম্ভ করে কারণ তখন থেকে আরম্ভ করে বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকের মধ্যে অনেক মুসলমান সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ করেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মীর মোশরাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম এবং জসীমউদ্দীন।
সাহিত্যে আরেকটি ঐতিহাসিক বিকাশ লক্ষ করা যায় তার আঙ্গিকের ক্ষেত্রে। মধ্যযুগে রচিত হয়েছিল কেবল আখ্যানমূলক কাব্য, কিন্তু উনিশ শতকে ইংরেজি সাহিত্য থেকে নতুন আঙ্গিক নিয়ে লেখা হয় মহাকাব্য, পত্রকাব্য, সনেট, খন্ড কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ। আর বিশ শতকে এসে বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের হাতে আরও উন্নতমানের সাহিত্য রচিত হয় এবং তা বিশ্বমানের মর্যাদা লাভ করে।
নগরায়ণ এবং নাগরিক সাহিত্য বিকাশ লাভ করায়, লোকসাহিত্য একদিকে যেমন ক্ষয়িষ্ণুতার দিকে এগিয়ে যায়, তেমনি রবীন্দ্রনাথ, দীনেশচন্দ্র সেন এবং অন্যান্য উৎসাহী গবেষকদের সম্মিলিত চেষ্টার ফলে তা আবার লিখিত আকারে সংগৃহীত হয় এবং ব্যাপকতর পাঠকদের কাছে পৌঁছে যায়। ফলে লোকসাহিত্য ও লোকসঙ্গীত কতোটা ঐশ্বর্যমন্ডিত এবং সুন্দর, শহরের শিক্ষিত পাঠকরা ও শ্রোতারা তা অনুভব করেন।
বঙ্গীয় সমাজ প্রধানত গ্রামীণ বলে উপনিবেশিক আমলের মাঝামাঝি কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য খানিকটা সংস্কৃত এবং ফারসি সাহিত্য দিয়ে প্রভাবিত হলেও, তা ছিল মূলত লৌকিক। ইংরেজি শিক্ষা এবং সাহিত্যই একে নাগরিক চরিত্র দান করে। তা সত্ত্বেও লোকসাহিত্যের প্রভাব একটু দুর্বলভাবে হলেও উনিশ ও বিশ শতকেও অব্যাহত থাকে। নাগরিক সম্প্রদায়ের শিকড়ও গভীরভাবে গ্রামে প্রোথিত হওয়ায়, বাংলা সাহিত্যে গ্রামের দিকে ফিরে তাকানোর একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যেমন, জীবনানন্দ দাশ এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অথবা জসীমউদ্দীন এবং আল-মাহমুদের রচনায় বারবার গ্রাম ফিরে আসে নানা রূপে। এখনকার অসংখ্য উপন্যাস এবং নাটকেও গ্রামের দিকে ফিরে তাকানোর এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
সঙ্গীত, নাটক, সিনেমা সাহিত্যের মতো বাংলা সঙ্গীতের উত্তরাধিকারও ঐশ্বর্যমন্ডিত। চর্যাপদ এবং মধ্যযুগের সাহিত্যের অনেকটাই ছিল আসলে গান। কোন রাগ এবং তালে গাইতে হবে প্রতিটি চর্যার (শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেরও) শুরুতেই তা উল্লিখিত হয়েছে। গৌড় ও বঙ্গাল এবং আরও পরে ভাটিয়ালির মতো রাগসমূহের নাম থেকে বোঝা যায় যে বঙ্গভূমিতে সুবদ্ধ এবং লোকসঙ্গীতের নিজস্ব ধারা সেকালেই গড়ে উঠেছিল। বৈষ্ণব সঙ্গীতজ্ঞরা মধ্যযুগেই রাগ এবং লোকসঙ্গীতের সমন্বয় ঘটিয়ে বঙ্গের নিজস্ব ভক্তিবাদী কীর্তন গানের ধারা প্রবর্তন করেছিলেন এবং তাকে প্রামাণ্য রূপ দিয়েছিলেন। বঙ্গের আর আর-একটি বিশিষ্ট ভক্তিবাদী সঙ্গীতের ধারা হলো বাউল গান। এই বিশেষ শ্রেণির গানের একজন শ্রেষ্ঠ রচয়িতা এবং সুরকার ছিলেন লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০)। বাউল গান তার সরলতা এবং সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত এবং এখন একুশ শতকের গোড়াতেও তার আবেদন হারিয়ে ফেলেনি। বাংলা সঙ্গীতের অন্যান্য ধারার মধ্যে আছে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কবিগান, জারিগান ইত্যাদি। প্রথম দু ধরনের গান শহর এবং গ্রাম উভয় জায়গায় জনপ্রিয় আর শেষ দু ধারার গান গ্রামে খুবই জনপ্রিয়।
উনিশ শতকের গোড়ায় বঙ্গদেশে দু ধরনের সুবদ্ধ সঙ্গীতের সূচনা এবং বিকাশ লক্ষ করা যায়- টপ্পা ও আখড়াই এবং বাংলা ধ্রুপদ। তাছাড়া, এ সময়ে বাংলা সঙ্গীতের জগতে ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র আসতে আরম্ভ করে, বিশেষ করে বেহালা এবং অর্গান, যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো হারমোনিয়াম। বাংলা সাহিত্যের মতো বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উনিশ শতক থেকে আরম্ভ করে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত সৃজনশীলতার একটা স্ফূরণ ঘটে। এই সময়ে নিধু গুপ্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন এবং নজরুল ইসলামের মতো বিখ্যাত গীতিকার ও সুরকারের বিশাল অবদানে বাংলা গানের জগৎ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার মতো উনিশ শতকে যে গানের ধারা তৈরি হয়, তা ভারতীয় সঙ্গীত থেকে খানিকটা ভিন্ন এবং বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাদ্যযন্ত্রের বলতে গেলে কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বঙ্গদেশে নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রীদের আবির্ভাব ঘটে। আর, বিশ শতকে বাদ্যযন্ত্রীদের সংখ্যাই কেবল বৃদ্ধি পায়নি, বরং আলাউদ্দীন খানের নেতৃত্বে আলি আকবর খান এবং রবিশঙ্করের মতো বিশ্বমানের শিল্পীদেরও বিকাশ ঘটে। বিশ শতকে কণ্ঠ শিল্পীরাও ‘রাগপ্রধান গান’ নামে সুবদ্ধ সঙ্গীতের একটি বিশিষ্ট ধারা গড়ে তোলেন। কিন্তু যে ধারার উদ্ভব এবং বিকাশ সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ঘটে, তা হলো আধুনিক গান। এ গান আসলে রাগসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত এবং পশ্চিমা সঙ্গীতের এক ধরনের সমন্বয়। এর আদি রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ। তাঁর এসব গান রবীন্দ্রসঙ্গীত নামে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। নজরুল ইসলাম, পঙ্কজ মল্লিক, সলিল চৌধুরী এবং অন্যরা মিলে এই ধারায় নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসেন। কিন্তু বেশির ভাগ আধুনিক গানেই রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত দুটি বৈশিষ্ট্য কমবেশি অনুকরণ কর হয়। এই দুই বৈশিষ্ট্য হলো: গানের চারটি তুক বা সুরের স্তবক এবং কথার প্রাধান্য।
গীতগোবিন্দ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে মনে হয়, আদি-মধ্যযুগেও বঙ্গভূমিতে এক ধরনের সাঙ্গীতিক পালা প্রচলিত ছিলো। এ ছাড়া, সে সময়ে মুক্তমঞ্চ যাত্রাপালাও বিকাশ লাভ করতে থাকে। চৈতন্যদেব এ রকমের একটি পালায় অভিনয় করেছিলেন বলে জানা যায়। তার দু শতাব্দী পরে আঠারো শতকে যখন বাংলা গদ্য বিকাশ লাভ করতে থাকে, তখন যাত্রাপালায় কাহিনী এবং গদ্যসংলাপ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে তাতে নাটকীয়তাও বাড়তে থাকে। বাঙালিরা আরও কতো কাল এই যাত্রা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন, তা অনুমানের বিষয়। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসন ভার নেওয়ার আগেই কলকাতায় একটি ইংরেজি থিয়েটার স্থাপিত হয়। কয়েক দশক পরে স্থাপিত হয় আরও বড় এবং আরও উন্নতমানের একটি থিয়েটার। এই দুই থিয়েটার বাঙালিদের জন্যে অনুকরণ করার মতো আদর্শ দান করে। গেরাশিম লেবেদফ নামে কলকাতায় বসবাসকারী একজন রুশ ভদ্রলোক বাঙালিদের উৎসাহ এবং চিন্তাকে আরও উস্কে দেন একটি ইংরেজি নাটক বাংলায় অনুবাদ করে বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাহায্যে ১৭৯৫ সালের শেষে এবং ১৭৯৬ সালের গোড়ার দিকে মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে। এর জন্যে তিনি কলকাতায় একটি মঞ্চ নির্মাণ করিয়ে নিয়েছিলেন। ১৮৩০-এর দশকে প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং নবীন বসু যে একাধিক নাটক অথবা যাত্রা পালা নিজেদের মঞ্চে অভিনয় করিয়েছিলেন, লেবেদফের দৃষ্টান্ত তার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করা অসম্ভব নয়।
তবে ১৮৫২ সালের আগে বাংলা ভাষায় কোনো নাটক প্রকাশিত হয়নি। একবার নাটক রচনার ধারা শুরু হবার পরে পরবর্তী কয়েক বছরে আরও অনেকগুলো নাটক প্রকাশিত হয়েছিল। ইতোমধ্যে ১৮৫৭ সাল নাগাদ কলকাতায় ব্যক্তিগত উৎসাহে মঞ্চ নির্মাণ এবং তাতে নাটকের অভিনয় আরম্ভ হয়। প্রথম দিকে প্রধানত সামাজিক ও পৌরাণিক নাটক এবং প্রহসনের অভিনয় জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এভাবে একাধিক মঞ্চে বেশ কয়েকটি নাটক ও প্রহসন সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হওয়ার পর শিক্ষিত সমাজ একটি সাধারণ মঞ্চ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। শেষ পর্যন্ত ন্যাশনাল থিয়েটার নামে সেই মঞ্চ স্থাপিত হয় ১৮৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে এবং সেখানে প্রথম অভিনীত হয় নীলচাষীদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী নিয়ে রচিত দীনবন্ধু মিত্রের জনপ্রিয় নাটক নীলদর্পণ। তার কয়েক বছরের মধ্যে হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার, গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার এবং বেঙ্গল থিয়েটার নামে আরও কয়েকটি থিয়েটার গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী থিয়েটার ‘স্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৩ সালে। এর পেছনে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা ছিল সেকালের বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং বিখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর।
বিশ শতকে আরও কয়েকটি নামকরা থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেখা দেন শিশির ভাদুড়ী ও অহীন্দ্র চৌধুরীর মতো শক্তিশালী অভিনেতা। আর কিছু পরে যাত্রা শুরু হয় সিনেমা এবং টেলিভিশনের। বাংলা থিয়েটার এখনো বিশ্বমানের না হলেও, বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের কয়েকটি চলচ্চিত্র সারা পৃথিবীতে খ্যাতি লাভ করেছে। সুযোগ এবং সুযোগ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভাবে বাংলাদেশের সিনেমা-শিল্প অবশ্য অনেকটাই পিছিয়ে আছে। ১৯৪০ এর দশকে বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে এবং নবান্ন নাটকের অভিনয় থেকে বাংলা থিয়েটার এবং নাটক উভয়েরই যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। মুসলমান সমাজের বিরূপ মনোভাবের কারণে বাংলাদেশে নাটকের অভিনয় দীর্ঘকাল কোনো উৎসাহ পায়নি। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের থিয়েটারে দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে।
বহু শতাব্দী ধরে বাঙালি সংস্কৃতি পরিশীলিত এবং বৈদগ্ধ্য লাভ করে তা কেবল নাগরিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেনি, বরং একটা আন্তর্জাতিক চরিত্রও অর্জন করেছে। তা সত্ত্বেও সাধারণ বাঙালিরা মূলত লোক উপাদান দিয়ে মুগ্ধ হন। বাংলার লোকসাহিত্য, লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্য, লোকনাট্য ইত্যাদির সঙ্গে ভক্তিবাদ বাঙালি মানসকে যথার্থভাবে প্রতিফলিত করে।
ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন ও পরিবর্তনের জোয়ার তেরো থেকে আঠারো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলিম শাসনকে এক কথায় বলা যায় শাসকের পরিবর্তন- হিন্দুদের বদলে মুসলমানের। কিন্তু এর ফলে বাঙালি সমাজের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে সেই সামন্ততন্ত্রের ভিত্তিতে নাড়া লাগে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে প্রজাদের ওপর জমিদারদের পরোক্ষ শাসন বহাল থাকলেও, ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্মাণ শিল্প, সেবামূলক শিল্পসহ অর্থনীতির সর্বত্রই দেখা দেয় পুঁজিবাদের প্রকাশ। এ সময়ে যে ব্যবসায়ী, ঋণদাতা এবং চাকুরিজীবী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে তাও ঘটেছিল উপনিবেশিক শাসনের প্রয়োজনে।
স্থানীয় জনগণের প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়, উপনিবেশিক শাসনের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি করার উদ্দেশ্যেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, টেক্সটবুক সোসাইটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। বঙ্গীয় সমাজে এ ধরনের শিক্ষা-কাঠামো কখনও ছিল না। বলা যেতে পারে, এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দেশীয়রা যে লাভবান হন, তা হয়েছিলেন পরোক্ষ ফল হিসেবে। উপনিবেশিক শক্তি যা-কিছু গুরুত্ব দিয়ে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে, তা করেছিল শোষণকে আরও ফলপ্রসূ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এসব উদ্যোগের ফলে বঙ্গীয় সমাজের ভিত্তিমূলেই প্রবল ধাক্কা লেগেছিলো।
ব্রিটিশ আমলে বঙ্গদেশে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে। এই শ্রেণিও গড়ে উঠেছিল উপনিবেশিক কারণে। উপনিবেশ থেকে কেন্দ্রে সম্পদ স্থানান্তরিত করা এবং উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা সুচারুভাবে চালানোর উদ্দেশে একটা স্থানীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির দরকার ছিল-যার একাংশে থাকবে একটি ভূমি-মালিক শ্রেণি, অন্য অংশে থাকবে শিক্ষিত এবং চাকুরেদের একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই বঙ্গীয় গ্রামীণ সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে এবং বৈদগ্ধ্য দান করে বর্তমান আকারে পৌঁছে দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ শাসন-ব্যবস্থা, আগেকার ধর্মীয় শিক্ষার জায়গায় উদারনৈতিক
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: