08/21/2025 আলিয়া মাদ্রাসা: অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার একটি ঐতিহ্য
২১ আগস্ট ২০২৫ ০২:৪৫
আলিয়া মাদ্রাসা ধারা: এক অবহেলিত ইতিহাস
আলিয়া মাদ্রাসা ধারা নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে ফিচার ফটোতে আমরা কি লক্ষ্য করেছি? হ্যাঁ, মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকার প্রধান গেটের ছবিটি। সেখানে লাল বৃত্ত দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিষ্ঠার সাল—১৭৮০। অর্থাৎ ১৭৮০ সালে বৃটিশ উপমহাদেশে সরকারিভাবে একটি নতুন শিক্ষা ধারার সূচনা হয়।
প্রশ্ন আসতে পারে—এ দেশে প্রথম সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনটি? অনেকেই হয়তো বলবেন, ঢাকা কলেজ, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪১ সালে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আলিয়া মাদ্রাসা সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলেজেরও ৬১ বছর আগে জন্ম নিয়েছিল, উপমহাদেশে প্রথম আনুষ্ঠানিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও ৭৭ বছর আগে, এবং আমাদের দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও ১৪১ বছর আগে। এক অর্থে আলিয়া মাদ্রাসাই এ অঞ্চলের প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার প্রথম ধারা।
কিন্তু আজ কী অবস্থায় আছে এই ধারা? শত শত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত বা জাতীয়করণ হলেও আলিয়া মাদ্রাসা ধারা রয়ে গেছে অবহেলিত। দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলমান এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ধারায় এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ হয়েছে। এই চিত্রই স্পষ্ট করে দেয়—আমাদের নীতিনির্ধারকেরা মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে কতটা আন্তরিক ছিলেন।
আসলে ঢাকার এই মাদ্রাসা-ই-আলিয়াই হলো ১৭৮০ সালে ইংরেজদের হাতে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত সেই আলিয়া মাদ্রাসা। দেশ বিভাজনের পর প্রায় সবকিছু—বই-পুস্তক, বেঞ্চ-টেবিলসহ অস্থাবর সম্পদ—ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়, শুধু জমি ও স্থাপনা ছাড়া। ১৯৪৭ সালে আমরা একে সম্মান দেখিয়ে মুসলিম ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আমাদের মাটিতে স্থান দিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর সেই সম্মান ধরে রাখতে পারিনি। হয়তো পারলে আজ আরও অনেক মাদ্রাসা সরকারিকরণ হতো।
অপরদিকে কলকাতার সেই আলিয়া মাদ্রাসা আজও টিকে আছে এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি পাবলিক স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়ে সগর্বে জ্ঞানচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অথচ আমাদের দেশে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা ন্যায্য জীবন ও সম্মানজনক জীবিকার দাবিতে শাহবাগের রাজপথে রক্তাক্ত হচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা এখন আস্থার প্রতীক। ধর্মভেদ না করেই অন্য সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা সেখানে বাড়ছে। কারণ তারা মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করেছে—ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক, মানসম্মত শিক্ষা প্রদানকে মূল লক্ষ্য করেছে। এজন্য পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য একজন পূর্ণকালীন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশে?
আমরা উন্নয়নের কথা বলি, অথচ মাদ্রাসা শিক্ষা উন্নয়নে যথাযথ উদ্যোগ নেই। বরং মাদ্রাসা শিক্ষাকে দোষারোপ করি। আসলে এর মাধ্যমে আমরা আমাদের জাতিসত্তারই ক্ষতি করে চলেছি।
আমরা অনেকেই হযতো ভুলে গেছি, এক সময় আলিয়া মাদ্রাসাই ছিল বাংলাদেশে শিক্ষার আলোকবর্তিকা। আজ সে ধারা দাঁড়িয়ে আছে অবমূল্যায়ন, সামাজিক অবজ্ঞা এবং নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতার ক্রসফায়ারে। ১৭৮০ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষার যুগপৎ সমন্বয়ে যে আধুনিক ধারার সূচনা করেছিল, আজ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থ সংকটে জর্জরিত, প্রান্তিক এবং ভুলভাবে অনুধাবিত এক শিক্ষা ব্যবস্থা।
হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য
আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস গৌরবময়। এই ধারা জন্ম দিয়েছে নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো জ্ঞানতাপস ও রাষ্ট্রনায়কদের। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে এই ধারাটি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও বিনিয়োগের অভাবে ধ্বংস হয়ে যায় সেই বিদ্যাবিন্যাসের ঐতিহ্য, যে ব্যবস্থাটি এক সময় জাতি গঠনের মূল কেন্দ্র ছিল।
ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমি নিঃশব্দ হয়ে পড়েছিলাম। কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি। একসময়ে যে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে জন্ম নিয়েছিল বিজ্ঞানী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, গবেষকের মতো বহু কৃতী মানুষ—আজ সেই ধারাটি যেন থেমে গেছে। এই শিক্ষা ধারার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নবাব আবদুল লতিফ, খ্যাতিমান বিচারপতি ও লেখক সৈয়দ আমীর আলী, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক মোহাম্মদ আকরাম খান, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। এছাড়াও রয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা এবং বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ প্রমুখ।
প্রশ্ন জাগে—গত অর্ধশতাব্দী ধরে কেন এই মাদ্রাসাগুলো আর তেমন কৃতি ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে পারছে না? উত্তর একটাই—আমাদের অবহেলা, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাহীনতা এবং সদিচ্ছার অভাব।
পরিসংখ্যান বলছে সংকট প্রকট
২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ৯,২৫৯টি পোস্ট-প্রাইমারি আলিয়া মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৭.৫ লাখ। দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় এই শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ প্রায় ২০ শতাংশ হলেও ৯৯.৯৭ শতাংশ মাদ্রাসা বেসরকারিভাবে পরিচালিত হয়। ২৭০টি কামিল মাদ্রাসার মধ্যে মাত্র ৩টি সরকারি ব্যবস্থাপনায়।
শিক্ষক সংকট, ১:৪৫ পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত এবং জরাজীর্ণ অবকাঠামোতে ধুঁকছে এই ধারা। মাত্র ৩৬ শতাংশ মাদ্রাসায় রয়েছে বিজ্ঞান ল্যাব, আর মাত্র ২৭.৬৯ শতাংশ শিক্ষকের প্রশিক্ষণ রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের হার অত্যন্ত নগণ্য। দাখিল ও আলিম পর্যায়ে মেয়েদের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি হলেও কামিলে তা নেমে আসে মাত্র ২২ শতাংশে।
কাঠামোগত বৈষম্য
একজন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আলিয়া মাদ্রাসার সংকট শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, এটি মানসিক ও নীতিগত বৈষম্যেরও ফসল। দীর্ঘদিনের অবহেলা মাদ্রািসা শিক্ষাকে কাংখিত স্থানে থাকতে দেয়নি। দিনকে দিন এর গুণগত মাসনর অবনমন ঘটেছে।
পাঠ্যক্রমের পক্ষপাত: অনেক ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সমকালীন ইতিহাস বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। চিন্তাশীলতা তৈরির পরিবর্তে গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
উত্তরণের পথ:
আলিয়া মাদ্রাসা ব্যবস্থার সংস্কার এখন সময়ের দাবি। এই মুহূর্তে বাস্তবায়নযোগ্য কিছু পদক্ষেপ হতে পারে:
পরিশেষে বলা যায়, আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি অবহেলা শুধু একটি নীতিগত ব্যর্থতাই নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। সময়োপযোগী সংস্কার ছাড়া এই শিক্ষায়তনগুলো কেবল ধর্মীয় আদর্শ নয়, গোটা প্রজন্মের স্বপ্ন ধ্বংস করে ফেলবে। প্রশ্ন হলো—একটি জাতি তার এক-পঞ্চমাংশ শিক্ষার্থীর প্রতি এমন অবহেলা করে কিভাবে নিজেদের অগ্রসর দাবি করতে পারে?
এখন সময়, আলিয়া মাদ্রাসার ঐতিহ্যকে শুধুমাত্র স্মৃতিচারণে নয়, বাস্তবিক উন্নয়নে ফিরিয়ে আনার—সুযোগ, শ্রদ্ধা ও সুশাসনের মাধ্যমে।
— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com