12/16/2025 দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে চুমুক দেওয়া পাঠক চাই না”:
odhikarpatra
২২ November ২০২৫ ১৮:৫৫
বিশেষ প্রতিনিধি, অধিকার পত্র ডটকম
মাথার ওপর কোনো ছাদ নেই, আছে শুধু প্লাস্টিকের নড়বড়ে এক তাঁবু। কখনো গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে শরীর পুড়ে যাচ্ছে, আবার কখনো হাড়কাঁপানো শীতে জমে যাচ্ছে হাত। এর মধ্যেই ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে একমনে লিখে চলেছেন ২৪ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি তরুণ ওয়াসিম সাইদ।
চারপাশে যখন বিরামহীন বোমার শব্দ আর মৃত্যুর মিছিল, তখন ওয়াসিম হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। তিনি লিখছেন এক মহাকাব্য—না, কোনো কল্পকাহিনী নয়। তিনি লিখছেন “Witness to the Hellfire of Genocide” (গণহত্যার নরককুণ্ডের সাক্ষী)
গাজার তরুণ লেখক ওয়াসিম সাইদ তার নতুন বই Witness to the Hellfire of Genocide-এ ইসরায়েলের হামলার ভয়াবহতা ও বেসামরিক মানুষের অজ্ঞাত কষ্টের কাহিনী তুলে ধরেছেন। দুই বছরের যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞের সময় তার অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষদর্শী গল্পগুলো বইয়ে সংকলিত হয়েছে।
সহানুভূতির প্রয়োজন নেই আমার”
আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াসিমের কণ্ঠে কোনো আকুতি শোনা যায়নি, ছিল তীব্র ধিক্কার আর অভিমান। বিশ্ববিবেকের কাছে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন। তার ভাষায়:
“আমার আপনাদের সহানুভূতির কোনো প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন এমন একটি বিবেকের, যা এখনো পচে যায়নি... আমার এমন একজন মানুষ দরকার যে পাথরে পরিণত হয়নি। আমি এমন কোনো পাঠক চাই না, যিনি আমার বই পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন, আর পরমুহূর্তেই সব ভুলে গিয়ে কফিতে চুমুক দিতে চলে যাবেন।”
এই কথাগুলো যেন বিশ্বজুড়ে নিরাপদ ঘরে বসে থাকা কোটি মানুষের বিবেকে চাবুক মারে।
ওয়াসিম জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট নেই এমন পরিবেশে মোমবাতি জ্বালিয়ে লিখেছেন তিনি। তার প্রতিটি অধ্যায় এমন মানুষের গল্প বলে যাদের মৃত্যু বা বেদনা আগে কেউ জানত না। তিনি বলেন, “আমি শুধু সহানুভূতির জন্য লিখছি না, আমি চাই যে পাঠক বইটি পড়ে সচেতন হোক এবং কিছু করার চেষ্টা করুক।”
বন্দুক নয়, কলমই যেখানে প্রতিরোধের শেষ অস্ত্র
ওয়াসিম জানান, তার এই লেখা কোনো শৌখিনতা নয়, এটি অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। গাজায় গত দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে হাজারো মানুষ শুধু মারা যায়নি, মুছে ফেলা হয়েছে তাদের স্মৃতি, তাদের নাম। ওয়াসিম সেই নামহীন, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর গল্প তার বইয়ের পাতায় অমর করে রাখতে চান। বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের নাম রাখা হয়েছে কোনো না কোনো শহীদের নামে।
তাঁবুর জীবন ও একটি পাণ্ডুলিপি
ওয়াসিম বর্তমানে বাস্তুচ্যুত। নিজের ঘর হারিয়ে তিনি এখন শরণার্থী। কিন্তু তার বিশ্বাস, এই পাণ্ডুলিপিটি একদিন গাজার মানুষের ওপর হওয়া অবিচারের দলিল হয়ে থাকবে। যখন পৃথিবী চুপ ছিল, তখন ওয়াসিমের কলম চিৎকার করে বলেছে—আমরা ছিলাম, আমরা বেঁচে ছিলাম।
ওয়াসিম সাইদের এই বই হয়তো যুদ্ধ থামাবে না, কিন্তু এটি ভবিষ্যতের আদালতের জন্য প্রমাণ হয়ে থাকবে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উঠে আসা এই তরুণের গল্প আমাদের শেখায়—সব কেড়ে নেওয়া গেলেও, মানুষের কণ্ঠস্বর কেড়ে নেওয়া যায় না।
তিনি আরও বলেন, “গল্পগুলো হারিয়ে যাবে যদি তা ডকুমেন্ট করা না হয়। এই লেখালেখি আমার নীরব প্রতিরোধ এবং ইতিহাসের সাক্ষ্য।” গাজার বেসামরিক মানুষের কষ্ট, ধৈর্য ও সংগ্রামের এই দলিল ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ধরা হবে।
ওয়াসিমের বই আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে গাজার বাস্তবতা পৌঁছে দিতে পারে, এবং তরুণ লেখকের এই সাহসিকতা বিশ্বমঞ্চে মানবিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা