12/10/2025 মুখোশের বাজারে মানবতা হারায়, আসল মানুষ চেনা দায়? —মুখ নয়, মন দিয়ে মানুষ চিনতে আত্মজিজ্ঞাসামূলক ও মানবিক এক আহ্বান
Dr Mahbub
১০ December ২০২৫ ০৬:৪২
বাংলা সমাজে চেহারার আড়ালে লুকোনো মুখোশ, ক্ষমতা-অহংকারের রূপান্তর, ভুলে যাওয়া ইতিহাস, ধর্ম ও মানবতার সংকট, এবং প্রতারণা-গুজবে ভরা বাস্তবতার একটি বিশ্লেষণধর্মী ও গল্পনির্ভর ফিচার নিবন্ধ। মুখোশধারী মানুষের ভিড়ে খাঁটি মানুষ খুঁজে ফেরার সামাজিক সত্য ও আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। সময় এখন উত্তর দেওয়ার—কিন্তু আমরা কি শুনতে প্রস্তুত!
চেহারার পেছনে আরেক চেহারা: আমাদের সমাজের লুকোনো আয়না
শহরের সকালগুলো এখন আর আগের মতো থাকে না। মানুষের মুখের ওপর আলো পড়ে, কিন্তু বোঝা যায় না আলোটা কার। যেন সবার মুখেই ঝিলমিল রং চড়ানো একেকটা মুখোশ। বাংলা ভাষার সেই পুরনো প্রবাদ— “চেহারার পেছনে মুখোশ পড়া মানুষগুলোই আজ সবচেয়ে ভদ্র সাজে”—আজ যেন প্রতিদিনের খবর।
মানুষ এখন বড় হতে চায় শর্টকাট পথে। পরিশ্রম আর সততার পুরোনো রাস্তাটা যেন কাদামাটি হয়ে গেছে। ক্ষমতার স্বাদ একবার জিভে লাগলে যে আচরণ বদলে যায়, তা আমরা প্রতিদিন দেখি। মানুষ বদলায় না—বদলায় তার মুখোশ। যেন নাটকের মঞ্চে দাঁড়িয়ে একেক দৃশ্যে একেক সাজ।
বাংলা অভিধানে “কৃতঘ্ন” শব্দটা আছে, কারণ এদেশে তাকে না লিখে উপায় ছিল না। উপকারীর অপকার করতে যে অনায়াস তৎপরতা, তা অন্য ভাষার অভিধানে সচরাচর ধরা পড়ে না। একসময় দহরম-মহরম, একসাথে খাওয়া-হাসা, কিন্তু বিপদে পড়লে সেই মানুষই চোখ ফিরিয়ে নেয়। যেন ব্যথা দেখে মনখারাপ হয় না, বরং অদৃশ্য এক তৃপ্তি জন্ম নেয়। কেউ তখন কষ্ট সহ্য করতে করতে বলে— “অবহেলা করেছো? ঠিক আছে… সময় উত্তর দেবে তোমার থেকেও সুন্দরভাবে।”
এ কথার মানে গভীর। কারণ ইতিহাস বারবার ফিরে আসে। আজকের রাজা কাল ভিক্ষুকও হতে পারে। নবাব সিরাজের মতো, যে একদিন হাজার মেসাহেব ঘিরে ছিল, যুদ্ধের হারের পর খিচুড়ির লাইনে দাঁড়িয়ে ধরা পড়ে। রবার্ট ক্লাইভও হাসতে হাসতে লিখে যান—“এই জাতি তামাশা দেখে, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে পাথর তোলে না।
এ মাটির মানুষ শুধু মানুষকে নয়, ধর্মকেও মুখোশ পরিয়ে ফেলতে জানে। “ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি, শর্ষের চেয়ে টুপি বেশি”—এ উক্তির রসে যেমন ব্যঙ্গ আছে, তেমনই আছে শত বছরের বেদনাময় সত্য। ধর্ম এসেছে মনুষ্যত্ব জাগাতে। কিছু মানুষ সেটাকে শাসন আর শোষণের সরঞ্জাম বানিয়ে ফেলে। মানবতা তাই কোথাও গিয়ে আটকে থাকে।
পৃথিবীর সব জাতি ভুল থেকে শেখে। আমরা ভুলকেই তেমন মূল্য দিই না। ভুলের পর শিক্ষা নয়—প্রতিশোধ আর অহংকারই বড় হয়ে ওঠে। সমাজে সমালোচনাকে অপমান মনে করা হয়। আত্মসমালোচনা যেন নিষিদ্ধ। গুজবের পেছনে ছোটা জাতীয় খেলা। চিলে কান নিয়েছে—এ কথা শুনলেই কান ধরা নয়, চিল ধরতে ছোটা—এই আমাদের স্বভাব। আজকের সমাজে টাকার ওজনেই সম্মান মাপা হয়। শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াই যে চরিত্রের সনদও নিতে হয় চরিত্রহীনদের কাছ থেকে।
ভালোবাসা এখন ভারী হয়ে গেছে অহংকারে। “কে বড়”—এই তুচ্ছ প্রতিযোগিতায় সম্পর্ক নষ্ট হয়। ক্ষমা করা গুণ নয়, দুর্বলতা মনে করা হয়। ভালোবাসা ভুল বোঝার মতো মুহূর্তেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। মানুষকে সহজে বিশ্বাস করে ভুল করি, আবার সেই ভুলের ওপরই রাগ জমে। তবু ভুল থামে না।
সবাই সামনে হাসিমুখে থাকে, পেছনে হিসেব করে। ভালোবাসার মুখোশ পরে প্রতারণা চলে। বন্ধুত্বের মুখোশ পরে শত্রুতা। মিষ্টি কথাই এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র। কিছু মানুষ আছে যাদের সামনে একরকম, পেছনে আরেকরকম। এ সমাজে হীরা ফেলে কাঁচ তুলে নেওয়ার প্রবণতা ভয়ানকভাবে বাড়ছে। নিজেকেও মানুষ চিনতে পারে না—অপরকে কি চিনবে?
এই সব অন্ধকারের মাঝেও কিছু মানুষ আছে—খাঁটি মানুষ। যাদের ভরসার ওপর দাঁড়িয়ে সমাজ এখনো টিকে আছে। সংখ্যায় কম, কিন্তু আলোকে তেমনই লাগে—একটু হলেই চারপাশে ছড়িয়ে যায়। পরিবর্তন কোথা থেকে শুরু হবে? সেখানেই, আমাদের নিজেদের ভেতরেই। একটু সততা, একটু সহমর্মিতা, একটু আত্মজিজ্ঞাসা। এই সমাজ বদলাবে কি? হ্যাঁ, যদি আমরা ভুল স্বীকারে সাহসী হই।
মানুষ চিনতে শিখি। মুখোশ নয়, মন দেখি। আমি আশাবাদী— কারণ অন্ধকার যতই ঘন হোক, আলো খুঁজে নিতেই হয়।
অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
মূল পয়েন্টসমূহ