
শনিবার (২৮ জুন) বিকালে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের’ দাবিতে ইসলামী আন্দোলন আয়োজিত মহাসমাবেশে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। তিনি বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে ইসলামের বাংলাদেশ। তাই ইসলামের পক্ষের সব ভোট দিতে হবে এক বাক্সে। পিআর নিয়ে গণ-ঐকমত্য তৈরি হয়েছে; পিআর প্রশ্নে গণভোট দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে ভোট হলে অন্যান্য ধর্ম ও বিভিন্ন মত-পথের লোকজনও সংসদে যেতে পারবেন।
সমাবেশে অংশ নিতে শুক্রবার (২৭ জুন) দিবাগত রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও পিকআপে নেতাকর্মীরা ঢাকায় আসেন। ব্যানার-ফেস্টুন ও দলীয় প্রতীক হাতপাখা নিয়ে মিছিল-স্লোগান দিতে থাকেন নেতাকর্মীরা। দুপুর ২টায় সমাবেশের মূল পর্ব শুরুর কথা থাকলেও সকাল ১০টা থেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতারা বক্তব্য রাখেন। নেতাকর্মীর বিস্তৃতি আশপাশের এলাকা রমনা পার্ক, মৎস্য ভবন, শাহবাগ ও টিএসসি মোড় পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়।
চরমোনাই পীর বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ ত্যাগ স্বীকার করেছে। জুলাইকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের এই নেতা বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই। দেশের সব মানুষের ভোটের দাম সমান। কারও ভোট যাতে অবমূল্যায়ন না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তাই আগামী নির্বাচনে সংসদের উভয়কক্ষে অবশ্যই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। যে দল যতো শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তাদের সেই অনুপাতে আসন থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সবার মতের প্রতিফলন ঘটবে। কোনও দল জালেম হওয়ার সুযোগ পাবে না। এটা তরুণ প্রজন্মেরও দাবি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সব ধর্মের মানুষেরও দাবি। আজকের মঞ্চ এটা আবারও প্রমাণ করেছে।
বাহাত্তরের সংবিধানকে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণ দাবি করে মুফতি রেজাউল করীম বলেন, ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধান ছিল দেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাস ও গণআকাঙ্ক্ষাবিরোধী। সেই সংবিধান রচয়িতাদের স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করার ম্যান্ডেটই ছিল না। তারা ভিনদেশের সংবিধান অনুসরণ করেছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, সংবিধান মেনেই স্বৈরাচার তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের ফসল। এতো জনসমর্থন নিয়ে আর কোনও সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। আমরা নিঃস্বার্থভাবে এ সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছি। সংস্কার, বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের যে অঙ্গীকার নিয়ে আপনারা দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকুন। কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবেন না। নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করুন। আমরা আপনাদের পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকবো।
রেজাউল করীম বলে, মৌলিক সংস্কার নিয়ে গড়িমসি বিশ্বাসঘাতকতা। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগী মনোভাব চাই, চোখ রাঙানি চাইনি। তিনি জুলাইয়ের খুনিদের জেলের বাইরে থাকাকে সরকারের ব্যর্থতা বলে অভিহিত করেন।
সমাবেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চান এমন দলের নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন– জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরোয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, নেজামে ইসলামী বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমাদ আবদুল কাদের, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজী, জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।
ছিলেন সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিরাও
মহাসমাবেশে অন্য ধর্মের প্রতিনিধিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিক মহাসচিব, বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্রের সভাপতি দয়াল কুমার, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি নির্মল রোজারিও।
১৬ দফা ঘোষণাপত্র
মহাসমাবেশে ১৬ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন দলের যুগ্ম-মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান।
১. সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের সঙ্গে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি’ এ বিষয় অবশ্যই পুনঃস্থাপন করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্বের জন্য ইসলাম হলো রক্ষাকবচ। তার প্রতিফলন সংবিধানের মূলনীতিতে থাকতে হবে।
২. সংসদের প্রস্তাবিত উভয়কক্ষে সংখ্যানুপাতিক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে।
৩. জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে বৈষম্যহীন শোষণ-নিপীড়ন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে আগামী জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণা করতে হবে।
৪. আগামী দিনে বাংলাদেশে যাতে কোনও নির্বাচিত স্বৈরাচার, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও সন্ত্রাসী শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংস করতে না পারে এবং একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক রাষ্ট্রসংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
৫. সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অপরিহার্য। সেটা নিশ্চিতে জনপ্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। পতিত ফ্যাসিবাদের সহযোগী যারা এখনও জনপ্রশাসনে কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত অপসারণ করতে হবে। না হলে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করেই যাবে।
৬. পতিত ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে পালাতক অপরাধীদের আটকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে।
৭. দেশ থেকে পাচার করা অর্থ উদ্ধারে সক্রিয়, কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে।
৮. দেশে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও খুনখারাবি রোধে প্রশাসনকে আরও কার্যকর ও অবিচল হতে হবে।
৯. ভারতের সঙ্গে করা সব চুক্তি জনসন্মুখে প্রকাশ করতে হবে এবং দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করতে হবে।
১০. জাতীয় নির্বাচনের আগে সব পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। আগামীতেও জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব স্থানীয় নির্বাচনের বিধান প্রণয়ন করতে হবে।
১১. চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি ও সন্ত্রাসীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।
১২. জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে দেশে অবশ্যই একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
১৩. ঘুষ, দুর্নীতিসহ সব ধরনের নাগরিক হয়রানি বন্ধ করতে হবে। কোনও নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক কারণে হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ করতে হবে। হয়রানিমূলক সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। দেশের কোথাও কোনও রকম মব সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া যাবে না। মব সৃষ্টিকারীদের দমনে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।
১৪. দেশবিরোধী ও ইসলামবিরোধী সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলায় সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
১৫. আগামী জাতীয় নির্বাচনে দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক ও ইসলামী শক্তির ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
১৬. রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা, জনগণের জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং কাঙ্ক্ষিত উন্নতি ও অগ্রগতির লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সর্ব পর্যায়ে ইসলামের সুমহান আলোকিত আদর্শের অনুশীলন করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) শাহ ইফতেখার তারিক ও সহ-প্রচার সম্পাদক মাওলানা কেএম শরীয়াতুল্লাহর যৌথ সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন– দলের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম, মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ মাদানী, মুহাদ্দিস আব্দুল হক আজাদ, মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ, যুগ্ম মহাসচিব মাওলান গাজী আতাউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলম, মুফতি এছহাক মুহাম্মদ আবুল খায়ের ও মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম, কেএম আতিকুর রহমান।
সংগ্রহীত
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: