odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫, ৪ ভাদ্র ১৪৩২
মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও অন্তরালের বাস্তবতা

নোবেল শান্তি পুরস্কার

odhikarpatra | প্রকাশিত: ১৯ আগস্ট ২০২৫ ২২:১৮

odhikarpatra
প্রকাশিত: ১৯ আগস্ট ২০২৫ ২২:১৮

বিশেষ প্রতিবেদন

সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ২০২৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়াতে নোবেল শান্তি পুরস্কার সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে বাংলাদেশেও মানুষের মধ্যে নোবেল শান্তি পুরস্কার সম্পর্কে বিশেষ কৌতুহল দেখা যাচ্ছে। এইরূপ একটি পরিস্থিতিতে অধিকারপত্র বিষয়টি সহজ-বোধগম্য ভাষায় সকলেরে সামনে তুলে ধরতে এই প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছে।

আলোচ্য প্রতিবেদনে নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাস, মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও নির্বাচন পদ্ধতির অন্তরালে কি ঘটে তা তুলে ধরা হয়েছে।

আলফ্রেড নোবেলের স্বপ্ন শান্তির দর্শন

সামগ্রিক মানবতার জন্য সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতীক এই পুরস্কারটি সুইডিশ উদ্ভাবক, শিল্পপতি এবং অস্ত্র নির্মাতা আলফ্রেড নোবেল-এর শেষ ইচ্ছার প্রতিফলন। শান্তির প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ এবং বার্থা ভন সাটনারের মতো ব্যক্তিত্বের প্রভাবে তিনি এই পুরস্কার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন।

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশ্বের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কারগুলোর একটি। এটি সুইডিশ উদ্ভাবক ও শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেল–এর উইলের ভিত্তিতে ১৯০১ সাল থেকে প্রদান শুরু হয়। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, শারীরবিদ্যা/চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য এবং অর্থনীতির মতো ক্ষেত্রের পাশাপাশি শান্তিকে তিনি মানবতার চূড়ান্ত আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। আলফ্রেড নোবেল নিজে অস্ত্র নির্মাতা হয়েও মানবতাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর বন্ধু ও প্রেরণার উৎস ছিলেন শান্তিবাদী লেখিকা বার্থা ভন সাটনার, যিনি নিজেও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। তাঁর অনুপ্রেরণায় শান্তি পুরস্কার যুক্ত হয় আলফ্রেড নোবেলের উইলে উল্লিখিত পাঁচটি পুরস্কারের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে।

কারা নির্ধারণ করেন নোবেল বিজয়ীকে?

নোবেল তাঁর উইলে নির্ধারণ করে দেন, শান্তি পুরস্কারটি প্রদান করবে নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্ট (Storting) কর্তৃক নির্বাচিত পাঁচ সদস্যের নোবেল কমিটি। অন্যান্য পুরস্কারের মতো সুইডেন নয়, শান্তি পুরস্কার পরিচালিত হয় নরওয়েতে। কমিটিটি স্বাধীনভাবে মনোনয়ন বিবেচনা করে এবং চূড়ান্ত বিজয়ী নির্বাচন করে।

মনোনয়ন প্রক্রিয়া: কীভাবে জমা পড়ে একটি নাম?

নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন প্রক্রিয়া একটি অত্যন্ত গোপনীয়, আনুষ্ঠানিক এবং নৈতিকতার মানদণ্ডভিত্তিক ব্যবস্থা। কারা মনোনয়ন জমা দিতে পারেন তা নোবেল ফাউন্ডেশনের আইন দ্বারা নির্ধারিত:

  • আগের নোবেল বিজয়ীরা
  • নোবেল কমিটির সাবেক সদস্যরা
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা
  • আইনসভার সদস্যরা
  • আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারকরা
  • এবং নির্দিষ্টভাবে অনুমোদিত সংস্থাসমূহ

মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ সময় সাধারণত ৩১ জানুয়ারি এবং অনলাইন ফর্মের মাধ্যমে জমা দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। ২০২৫ সালের জন্য জমা পড়েছে ৩৩৮টি বৈধ মনোনয়ন, যার মধ্যে ২৪৪ জন ব্যক্তি এবং ৯৪টি প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত।

উল্লেখযোগ্য তথ্য: ২০১৬ সালে মনোনয়নের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক—৩৭৬ জন।

মনোনয়নের পরবর্তী ধাপ

মনোনয়ন জমা পড়ার পর কমিটি একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করে। এরপর এই তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করা হয়। এতে নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউট এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা যুক্ত হন।

পর্যালোচনা, সংক্ষিপ্ত তালিকা মূল্যায়ন

নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বৈঠকে বসে এবং মনোনয়ন তালিকা পর্যালোচনা করে। যদি প্রয়োজন মনে হয়, কমিটির সদস্যরা নিজেরাও নতুন প্রার্থীর নাম সংযোজন করতে পারেন।

এরপর তৈরি হয় একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা, যেখানে স্থান পায় সবচেয়ে শক্তিশালী, প্রভাবশালী ও টেকসই অবদান রাখা মনোনীতরা। তাদের কার্যক্রম বিশ্লেষণের জন্য যুক্ত হয় নোবেল ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দল এবং আন্তর্জাতিক গবেষকগণ।

বিজয়ী নির্বাচন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা

অক্টোবর মাসের শুরুতে নোবেল কমিটি তাদের শেষ বৈঠকে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করে। সাধারণত সম্মতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে প্রয়োজনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট গ্রহণ করা হয়। সাধারণত চূড়ান্ত নির্বাচন হয় অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে, কমিটির শেষ বৈঠকে। নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঐক্যমত্যের চেষ্টা করা হয়, তবে প্রয়োজনে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয় অসলো শহর থেকে, যা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। নোবেল শান্তি পুরস্কার কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তি বা সক্রিয় প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়। মনোনীত ব্যক্তি বা সংস্থার নাম ৫০ বছর পর্যন্ত গোপন রাখা হয়।

রাজনৈতিক বার্তা বিতর্ক

নোবেল শান্তি পুরস্কার অনেক সময় রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। ইতিহাসে দেখা গেছে, বিতর্কিত ব্যক্তিরাও এই পুরস্কার পেয়েছেন। তবে এর নৈতিকতা, মানবিকতা ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার মানদণ্ড সব সময় অগ্রাধিকার পায়।

কমিটির প্রধান জোরগেন ওয়াটনে ফ্রাইডনেস বলেন: “বাস্তবে যে কেউ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন। তবে এর জন্য চাই বিশ্বমানবতার কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা।”

পুরস্কার শুধু শান্তি নয়, রাজনৈতিক বার্তাও বটে?

নোবেল শান্তি পুরস্কার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার দাবি করলেও ইতিহাসে দেখা গেছে, অনেক সময় এটি রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। বিতর্কিত অনেক ব্যক্তিও এই পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন—হেনরি কিসিঞ্জার, ইয়াসির আরাফাত, বারাক ওবামা ইত্যাদি। কমিটির বর্তমান সভাপতি জোরগেন ওয়াটনে ফ্রাইডনেস স্পষ্টভাবে বলেছেন: “বাস্তবে যে কেউ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন। তবে এর জন্য চাই দূরদর্শিতা, টেকসই শান্তি স্থাপন এবং মানবিক অঙ্গীকারের প্রমাণ।”

সারসংক্ষেপ: নৈতিকতা টেকসই শান্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়

নোবেল শান্তি পুরস্কার একটি প্রতীক, যা ক্ষমতার নয়, বরং ন্যায়, সহানুভূতি ও টেকসই শান্তির অঙ্গীকারের স্বীকৃতি। এটি শুধুমাত্র মনোনয়ন নয়—একটি আদর্শ ও দায়িত্বের বিজয়।

নোবেল শান্তি পুরস্কার কেবল কোনো প্রচার বা বাহ্যিক সাফল্যের স্বীকৃতি নয়; এটি একধরনের নৈতিক ও কৌশলগত পরীক্ষার চূড়ান্ত স্বীকৃতি। মনোনয়ন পাওয়া যেমন সম্মানের, বিজয়ী হওয়া ততটাই দায়িত্বপূর্ণ। শান্তি যে কেবল যুদ্ধের অনুপস্থিতি নয়—বরং তা ন্যায়, সমতা এবং মানবিকতার নিরন্তর প্রচেষ্টার নাম—এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে নোবেল শান্তি পুরস্কার।

বিশেষ দ্রষ্টব্য:

এই প্রতিবেদনটি তথ্যভিত্তিক ও গবেষণালব্ধ উপাত্ত ব্যবহার করে প্রস্তুত করা হয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার সম্পর্কে আরও জানতে ভিজিট করুন: www.nobelpeaceprize.org

লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রাহমান (লিটু), অধ্রাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: