ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২
উপসম্পাদকীয়

শিক্ষা যদি অধিকার হয়, তবে কওমি বঞ্চনার ন্যায়সংগত ব্যাখ্যা কোথায়?” – উপসম্পাদকীয়

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২ জুলাই ২০২৫ ২২:৩৯

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২ জুলাই ২০২৫ ২২:৩৯

শিক্ষা যদি অধিকার হয়, তবে কওমি বঞ্চনার ন্যায়সংগত ব্যাখ্যা কোথায়?”
– উপসম্পাদকীয়

আর কত অবহেলা? আর কত উপেক্ষা? শিক্ষা যদি হয় সকল নাগরিকের জন্মগত অধিকার, তবে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি এই প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের দেয়াল কতদিন টিকে থাকবে?

২০২২ সালের BANBEIS তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৯,১৯৯টি এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। অথচ সরকার-অনুমোদিত আলিয়া মাদ্রাসা ধারায় ২০২৩ সালে প্রাথমিক থেকে মাস্টার্স পর্যায়ে মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ১৩,৫৫৯টি। কওমি ধারায় শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান সংখ্যা বেশি হলেও, বাজেট বরাদ্দ, উপবৃত্তি, নীতিনির্ধারণ, পরিসংখ্যান ও শিক্ষানীতি—সব ক্ষেত্রেই তারা থেকেছে বঞ্চিত ও অবহেলিত।
এটা শুধু কৌশলগত প্রশ্ন নয়, বরং এটি ন্যায়বোধ ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রশ্ন। শিক্ষা বরাদ্দের সমবণ্টনে প্রশ্নে যদি ন্যায়বিচার অনুপস্থিত থাকে, তাহলে রাষ্ট্র কীভাবে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার পালন করছে?
দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় কওমির শেয়ার উল্লেখযোগ্য ।
প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৬.৮৬% এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪১% কওমি ধারায় অধ্যয়ন করছে—এটা কোনো গৌণ সংখ্যা নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের এমন বিশাল অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটে কওমির জন্য কোনো বরাদ্দ নেই! হিসেব অনুযায়ী, ন্যূনতম ২,৫৭৮.২১ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রাপ্য হলেও তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

কওমির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে সরকারের শিক্ষা পরিকল্পনায় কওমির শিক্ষার কেপিআই সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ‍্য তথ‍্য ও বর্তমান সময়ের সাথে সঙতিশীল পরিসংখ্যান না থাকা। এ ধরণের একটি অবহেলার দৃষ্টান্ত হচ্ছে—বাংলাদেশের শিক্ষা পরিকল্পনা তথয ও উপাত্ত এর উপর নির্ভরশীল । আর এর প্রধান দায়িত্ব BANBEIS নামক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি অঙ্গসংগঠন। যারা প্রতিবছরের বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে প্রকাশ করে। তবে কওমি যেন দৃষ্টির বাইরে। ব্যানবেইস এখনো কওমি মাদ্রাসার তথ্য হিসেবে ২০১৫ সালের জরিপ ব্যবহার করছে, যা প্রায় এক দশক পুরোনো। বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ প্রকাশ করা হলেও, সেখানে কওমির তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি—এটিই কি নীতিনির্ধারকদের আন্তরিকতার প্রতিচ্ছবি? আমরা কী কওমি ধারার লাখো শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে শুধুই “সংখ্যা” হিসেবে দেখব? নাকি তাদেরও সম্মানজনক মর্যাদা দিয়ে শিক্ষানীতির মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করব?

বিদেশে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রম বাজার এককভাব্ সৌদি আরব, আর অঞ্চল হিসেব মধ‍্য প্রাচ‍্য। সেই দেশগুলোতে সার্বিকভাবে বিশ্বজুড়ে আরবি ভাষাভিত্তিক দক্ষ কর্মশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কওমি গ্র্যাজুয়েটদের আরবির পাশাপাশি কারিগরি দক্ষতা প্রদান করলে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে রপ্তানি হয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাই কওমি ধারায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর ও কারিগরি শিক্ষার প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি।
একটি রাষ্ট্র যদি শিক্ষায় বৈষম্য করে, তবে তার ভবিষ্যৎ নাগরিকদের নিয়ে যে সামাজিক সংকট তৈরি হবে, তা হবে এক প্রকার “শিক্ষাগত ফ্রাঙ্কেনস্টাইন”। শুধু উপেক্ষার সংস্কৃতি দিয়ে এই শিক্ষা ধারাকে অচল রাখা যাবে না।
আমরা যদি সত্যিই বলি, “শিক্ষা অধিকার”— তবে সেই অধিকার কওমি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। শিক্ষা প্রশাসনকে এখনই নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা পরিহার করে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কওমিকে দেখাতে হবে রাষ্ট্রীয় মা-বাবার ভালোবাসা, যেন তারা ঘরের সন্তান হয়ে দেশের আলোকিত ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।
শেষ কথায় বলা যায়, শিক্ষার অধিকার তখনই পূর্ণতা পায়—যখন প্রতিটি শিক্ষার্থী, প্রতিটি ধারার জন্য রাষ্ট্র ন্যায্যতা নিশ্চিত করে। কওমি ধারার প্রতি সম্মানহীনতা শুধু অবিচার নয়—এটা জাতির ভবিষ্যতের ওপর আত্মঘাতী আঘাত। এখনই সময়—সম্মান, সংহতি ও সমতার ভিত্তিতে কওমিকে শিক্ষা-পরিবারে মর্যাদার আসনে স্থান দেওয়ার।

বি:দ্র়: অধিকার পত্র সামনের সংখ‍্যায় ‘ঐতিহাসিক’ ও ‘অধিকার’ প্রত‍্যয়ের-লেন্স দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষায় বৈবষম‍্যের ধারা আলোচিত হবে। মাদ্রাসা ধারার শিক্ষা ব‍্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চোখ রাখুন। অধিকার পত্রের সাথে থাকুন। আপনার বা আপনার চারপাশে অধিকার সংক্রান্ত যেকোনো বিষয় আমাদের জানান, কেননা “অধিকারপত্র অধিকারের কথা বলে”॥

উপসম্পাদকীয়, ডক্টর  অধ্যাপক মুহাম্মেদ মাহবুবুর রহমান। ঢাকা বিশ্ব বিদঢ়ালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: