odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১ ভাদ্র ১৪৩২

ইসলামের শিক্ষা - ঈদে মিলাদুন্নবিতে বিশেষ নিবন্ধ : ন্যায়ের প্রদীপ জ্বালাও, অন্যায়ের আঁধার দূর করো

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:২৩

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:২৩

অন্যায় রুখিয়া দাড়ানোই ঈমানের দাবি

ঈদে মিলাদুন্নবিতে বিশেষ নিবন্ধ

মানুষের কথাবার্তা, কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ দ্বিমুখী। একটি ন্যায়, অপরটি অন্যায়; একটি শুভ, অপরটি অশুভ। মানবসমাজের জন্য আবশ্যক হইল শুভ ও ন্যায়ের পথে অগ্রসর হইবার প্রশিক্ষণ, এবং অশুভ ও অন্যায় হইতে বিরত থাকা। পৃথিবীর যত মত-পথ, দর্শন ও ধর্ম রহিয়াছে, সকলেরই মৌলিক উপদেশ এই একই—ন্যায়ের পথে চলা ও অন্যায় দমন করা। সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষ্য দিতেছে, যে সমাজ ন্যায়ের পতাকা সমুন্নত রাখিয়াছে, সেই সমাজই স্থাপন করিয়াছে শান্তি, শৃঙ্খলা ও মানবোন্নতির মহাপর্ব। আর যে সমাজ অন্যায়ের প্রশ্রয় দিয়াছে, সেখানে জন্ম লইয়াছে বিশৃঙ্খলা, অবিচার ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। অতএব অন্যায় হইতে আত্মরক্ষা যেমন আবশ্যক, তদ্রূপ অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধও একান্ত কর্তব্য। অন্যায় প্রতিহত না করিলে সমাজে বিশৃঙ্খলা বিস্তার লাভ করে, শান্তি ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, ন্যায়বিচার লুপ্ত হয়, মানবাধিকার খর্ব হয়।

ইসলাম, যাহাকে ন্যায় ও মানবতার ধর্ম বলা হয়, এই প্রসঙ্গে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করিয়াছে।পবিত্র কোরআন মজীদে মহান আল্লাহ ইরশাদ করিতেছেন—তোমরা উত্তম জাতি, মানবকল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হইয়াছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দিবে” (সুরা আলে ইমরান ১১০)।  আরও ইরশাদ রহিয়াছে—সৎ ও অসৎ সমান হইতে পারে না। উৎকৃষ্ট দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করো, তাহা হইলে যাহার সাথে তোমাদের শত্রুতা রহিয়াছে, সে হইবে অন্তরঙ্গ বন্ধু” (সুরা ফুসসিলাত ৩৪)। এই আয়াতসমূহ দ্বারা সুস্পষ্ট হইল—অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কেবল ব্যক্তিগত পছন্দ নহে, বরং আল্লাহর পক্ষ হইতে প্রদত্ত ফরজ দায়িত্ব।

ইসলামে অন্যায় প্রতিহতের গুরুত্ব অনেক। অন্যায় দমন কেবল ব্যক্তিগত দায়িত্ব নহে, বরং সামষ্টিক নৈতিক কর্তব্য। পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ইতিহাসে প্রমাণিত, যারা অন্যায়কারীদের বিরত রাখিতে ব্যর্থ হইয়াছে, তাহাদের সকলকেই ধ্বংসের সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। শাস্তি নেমিয়াছে গোটা জাতির উপর। এই বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সতর্কবাণী রহিয়াছে— “তাহারা একে অপরকে অন্যায় হইতে নিবৃত্ত করিত না; তাহারা যাহা করিত, তাহা কতই না নিকৃষ্ট।” (সুরা মায়েদা ৭৯)। অর্থাৎ, কেবল নিজে সৎ থাকিলেই চলিবে না; অন্যকে অসৎকর্ম হইতে বিরত রাখাও সমান কর্তব্য। অতএব, নীরবতা কখনোই সৎলোকের গুণ নহে, বরং পরিণত হয় ধ্বংসের কারণরূপে। ইসলাম, যাহা মানবতার ধর্ম এবং আল্লাহর চূড়ান্ত বিধান, এই প্রসঙ্গে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা হইল—অন্যায়কে প্রতিহত কর এবং ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা কর।

হযরত আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ইরশাদ করিতে শুনিয়াছেন মানুষ যদি অন্যায় দেখিয়া তাহার প্রতিবাদ না করে, তবে আল্লাহ অচিরেই তাহাদের সকলকে শাস্তির সম্মুখীন করিবেন।” (তিরমিজি ২১৬৮) অন্য হাদিসে নবী করীম (সা.) বলেন— সেই সত্তার শপথ, যাঁহার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয়ই তোমরা সৎকাজের আদেশ করিবে ও অন্যায় প্রতিরোধ করিবে; নতুবা আল্লাহ তাড়াতাড়ি তোমাদের উপর শাস্তি প্রেরণ করিবেন, তখন দোয়া করিলে তাও কবুল হইবে না” (তিরমিজি ২১৬৯)।  রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যায়ের প্রতিবাদকে উত্তম জিহাদ আখ্যা দিয়াছেন। তিনি বলেন—স্বৈরাচারী শাসকের সম্মুখে ন্যায়সংগত কথা বলাই শ্রেষ্ঠ জিহাদ।” (আবু দাউদ ৪৩৪৪)। অতএব অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ঈমানের শর্তস্বরূপ। এইখান হইতে স্পষ্টতই বলা যায়, প্রতিবাদ কেবল সাহস নয়, বরং ঈমানেরই অংশ।

সমাজের নীরবতা ও পরিণতি সম্পর্কে ইসলামে বার বার সতর্ক করা হয়েছে।  ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেন—“অন্যায় তখনই বিস্তার লাভ করে, যখন সৎলোকেরা নীরব থাকে।” ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন—“অন্যায়ের প্রতিবাদ ইসলামি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।” - এই উক্তিগুলি প্রমাণ করে, প্রতিবাদ না করিলে ন্যায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় না।

আমাদের বর্তমান ঘুণে ধরা সমাজে দুর্নীতি, গুম-খুন, ধর্ষণ, ব্যভিচার, সুদ-ঘুষ, লুণ্ঠন, জুলুম ইত্যাদি প্রতিনিয়ত বাড়িতেছে। অন্যায়ের প্রতিবাদে নীরবতা আজ সর্বত্র। অপরাধী ধরা পড়িলেও ক্ষমতার প্রভাব, তদবির ও ঘুষের কারণে শাস্তি এড়াইয়া যাইতেছে। ফলতঃ অপরাধীরা আরও সাহসী হইতেছে, সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হইতেছে। এই নীরবতা ইসলামের নির্দেশনার বিপরীত, আর এই বিপরীতাচরণই আজকের সামাজিক অরাজকতার অন্যতম কারণ। তবে ইসলামী দিকনির্দেশনা হইল—প্রতিবাদ করিতে হইবে শৃঙ্খলাপূর্ণ উপায়ে, যেন ফ্যাসাদ ও নতুন অন্যায়ের দ্বার না খোলে। পবিত্র হাদিস শরীফের এই প্রতিবাদের স্তর ও বাস্তবায়ন কৌশল স্পষ্ট করা হইয়াছে—

  1. হাত দ্বারা প্রতিরোধ করিবে (ক্ষমতা থাকিলে শক্তি প্রয়োগ করিয়া তথা সামর্থ্য থাকিলে হাত দ্বারা প্রতিরোধ করিবে)।
  2. মুখে প্রতিবাদ করিবে (শক্তি প্রয়োগে প্রতিবাদ করিতে না পারিলে মুখে প্রতিবাদ করিবে। শব্দ, উপদেশ, কলম ও প্রচার দ্বারা)।
  3. অন্তরে ঘৃণা করিবে (তাহাও না পারিলে অন্তরে ঘৃণা করিবে, আর ইহাই ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর)।

— (সহিহ মুসলিম ৭৪)

অতএব প্রত্যেক মু’মিনের কর্তব্য হইল—নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। এক্ষেত্রে সমাজের সকল স্তরের মুমিন মুসলমানের দায়িত্ব রহিয়াছে। সাংবাদিকতা ও কলমের দায়িত্ব এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কলমও বাকশক্তিরই সম্প্রসারিত রূপ। পত্র-পত্রিকা, বই, লেখনী, প্রতিবেদন—সবই অন্যায়ের প্রতিবাদের মাধ্যম। সৎ সাংবাদিকতা এবং সত্যভাষণও ‘আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার’-এর অন্তর্ভুক্ত। এ দায়িত্ব পালনকারীরা ইসলামের দৃষ্টিতে বিশেষ পুরস্কারের অধিকারী।

মনে রাখিতে হইবে, অন্যায় দমন কেবল ব্যক্তিগত দায়িত্ব নহে; বরং রাষ্ট্র, সমাজ ও সকল স্তরের সম্মিলিত কর্তব্য। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধ দমন করিবে, সমাজ নেতৃবৃন্দ সচেতনতা সৃষ্টি করিবে, আলেম-ওলামা সত্য প্রচার করিবে, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নৈতিকতাবোধে দীক্ষিত করিবে, আর সাধারণ নাগরিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অটল থাকিবে। বাস্তবিক অর্থেই সমাজকে যদি সুন্দর ও সমৃদ্ধ করিতে হয়, তবে অন্যায় দমন করা ব্যতীত বিকল্প নাই। প্রত্যেকের কর্তব্য হইল—সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতে এগিয়ে আসা। রাষ্ট্রের কর্তব্য হইল অপরাধ দমন ও শাস্তি নিশ্চিত করা। আর সমাজের কর্তব্য হইল অপরাধকে প্রশ্রয় না দেওয়া। আল্লাহর ভয় এবং ঈমানী চেতনা থাকিলে, আইন-শৃঙ্খলা তখনই কার্যকর হইবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা স্পষ্ট—ন্যায় প্রতিষ্ঠা করিবে, অন্যায় প্রতিহত করিবে।

আজ সময়ের দাবি হইল—অন্যায়ের আঁধারে ন্যায়ের প্রদীপ জ্বালানো। সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিমাত্রকে একযোগে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইতে হইবে যে, কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হইবে না। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রাচীর গড়িয়া তুলিতে হইবে। আজকের বাস্তবতায় অপরাধ দমন কেবল আইন দ্বারা সম্ভব নয়। প্রয়োজন আল্লাহভীতি, নৈতিক চেতনা এবং ঈমানী দায়িত্ববোধ। প্রত্যেকে যদি ন্যায় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে এবং অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়, তবে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইবে। যখন সমাজে প্রত্যেকে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হইবে, তখনই শান্তি ও শৃঙ্খলার সুবাতাস বইবে। আর তাহাই হইবে ন্যায়ভিত্তিক এক সুন্দর সমাজ ও সমৃদ্ধ মানবসভ্যতার সোপান। ইসলামের এই শিক্ষাই হইল ন্যায়বিচার, শান্তি ও মানবমুক্তির একমাত্র পথ।

অন্যায়ের আঁধারে ন্যায়ের প্রদীপ জ্বালানোই হইল ইসলামের আহ্বান, মানবতার মুক্তি এবং সভ্যতার কল্যাণের একমাত্র পথ।

— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: