-2025-08-17-22-08-42_copy_640x360-2025-08-17-23-04-05.jpg)
- সম্পাদকীয়
ধর্মের দীপ জ্বালো সদা, নিভিতে দিও না কভু,
নিভিলে জাগে বিভেদের অগ্নি, দাহে সর্বত্র তবু।
অশান্তির নহে কোনো উত্তর, বিভেদের নহে গতি,
ন্যায়ধর্মে বাঁধিলে মানব, স্থাপিত হইবে শান্তি।
— ধর্ম যদি হয় আলোকবর্তিকা, তবে তাহা নিভাইয়া বিভেদের অগ্নিশিখা প্রজ্বালিত করিবার অধিকার কাহারও নাই। তথাপি মানবসভ্যতার ইতিহাস সাক্ষ্য দিতেছে, যখনই ধর্মের শুদ্ধ প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছে, তখনই অন্ধকারে জ্বলে উঠিয়াছে হিংসা ও বিভেদের অগ্নিশিখা। মানবজাতির অভিযাত্রায় বারংবার পরিদৃষ্ট হইয়াছে—স্বার্থন্বেষীদের ষড়যন্ত্রে ধর্ম প্রায়শই ম্লান হইয়া পড়িয়াছে। এই লোভী দুষ্টুচক্র স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধির নিমিত্ত ধর্মকে বিকৃত করিয়া জনশোষণের ভয়াবহ অস্ত্রে পরিণত করিয়াছে এবং সমাজে অশান্তির রাজত্ব কায়েম করিবার অপচেষ্টা চালাইয়া আসিতেছে।আর আজও সেই অশান্তির অগ্নিশিখার দহন মানবসমাজকে ক্ষতবিক্ষত করিতেছে। প্রশ্ন জাগে—মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, অশান্তি ও অধিকারহীনতার অবসান কবে ঘটিবে?
মানবসভ্যতার আদি হইতেই ধর্ম ছিল শান্তি, ন্যায়, করুণা ও কল্যাণের দীপশিখা। ইতিহাসের দীর্ঘ অভিযাত্রায় ধর্মের বাণী বারংবার আলোকিত করিয়াছে মানবচরিত। প্রত্যেক ধর্মই মানুষকে দান করিয়াছে সত্য, দয়া, প্রেম, ন্যায় ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা। ইসলাম ঘোষণা করিয়াছে—“মানুষ সকলেই আদম-হাওয়ার সন্তান”; খ্রিষ্টধর্ম উচ্চারণ করিয়াছে—“Love thy Neighbor”; বৌদ্ধধর্মে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে অহিংসা ও করুণার অমীয় বাণী; হিন্দুধর্ম বলিয়াছে—“বাসুধৈব কুটুম্বকম”—সকল মানুষ একই পরিবারের অংশ। অর্থাৎ, ধর্মের মূলতত্ত্ব হইল সমতা, শান্তি ও মানবমুক্তির পথনির্দেশ।
কিন্তু দুঃখজনক, যখন ধর্মের প্রদীপ ম্লান হইয়া পড়ে, তখন মানুষের মানবতা বিস্মৃত হয়, ঘৃণা ও দমনের অগ্নি শিখা প্রজ্বলিত হয়। ইতিহাস প্রমাণ করে—যখনই ধর্মের প্রকৃত সারকথা, অর্থাৎ ন্যায় ও মানবসেবার শিক্ষা উপেক্ষিত হইয়াছে, তখনই পৃথিবী রক্তে রঞ্জিত হইয়াছে। সভ্যতার অগ্রযাত্রার সহিত অনেক স্থলে ধর্মের শিক্ষা বিকৃত হইয়াছে, ঘটিয়াছে অপব্যাখ্যা। ধর্মের নামে সংঘটিত হইয়াছে হানাহানি, হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংস। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির অজুহাত—সবই মানবতাকে বিদীর্ণ করিয়াছে। যে ধর্ম মানুষের অধিকার ও মর্যাদার রক্ষক হইবার কথা ছিল, সেই ধর্মকেই মানুষে মানুষে ভেদাভেদের যন্ত্রে পরিণত করা হইয়াছে।
মধ্যযুগীয় ক্রুসেড হইতে আধুনিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা—প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ধর্মের অপব্যবহার মানবসভ্যতাকে অশান্তির অন্ধকারে নিমজ্জিত করিয়াছে। যে ধর্ম সৃষ্টিকর্তার প্রেম ও সৃষ্টির কল্যাণ প্রচার করিবার জন্য আবির্ভূত হইয়াছিল, তাহাই হইয়াছে ক্ষমতা ও আধিপত্যের হাতিয়ার। ফলে মানুষের অন্তর হইতে মুছিয়া গিয়াছে করুণা; জন্ম লইয়াছে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও সহিংসতার দানব।
আজও বিশ্বের নানাস্থানে ধর্মের অপব্যবহার প্রতিদিনের সংবাদ হইয়া উঠিতেছে। কোথাও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভয়ে দিন গুণিতেছে; কোথাও নারী বৈষম্যের দুঃসহ যাতনায় নতশির; আবার কোথাও ধর্মের নামে রক্তপাত চলিতেছে অবিরাম। অথচ কোনো ধর্মই বিদ্বেষ, বৈষম্য বা নিপীড়নের অনুমোদন করে নাই। বরং সকল ধর্মের অন্তরালে সর্বদাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে একটিই চিরন্তন আহ্বান—মানুষকে মানুষরূপে মর্যাদা প্রদান, ভিন্নতাকে সহিষ্ণুতার সহিত গ্রহণ, এবং মানবসমাজকে শান্তির পথে প্রতিষ্ঠিত করা।
তথাপি যুগে যুগে স্বার্থান্ধ মানুষের হস্তে ধর্ম বিকৃত হইয়াছে। ক্ষমতালোভী গোষ্ঠী ধর্মকে পরিণত করিয়াছে জনশোষণের ভয়ংকর অস্ত্রে। আর আধুনিকতার এই যুগেও ধর্মকে বানানো হইতেছে ব্যবসা ও রাজনীতির ক্রীড়নক। এর ফলেই শিশুমনে বপিত হইতেছে বিদ্বেষের অঙ্কুর; যুবকের অন্তরে জাগ্রত হইতেছে সহিংসতার প্রলোভন; প্রান্তিক মানুষ ক্রমে বঞ্চিত হইতেছে ন্যায়বিচারের পবিত্র অধিকার হইতে। নারী, শিশু ও সংখ্যালঘুর অধিকার বারংবার পদদলিত হইতেছে; সমাজ হারাইতেছে শান্তি ও স্থিতিশীলতার অমূল্য ভিত্তি।
অতএব আজ মানবতার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে গুরুতর প্রশ্ন—ধর্ম কি হইবে বিভেদের অগ্নি, না কি মানবতার আলোকবর্তিকা? ইসলামের ঘোষণা—“A Complete Code of Life”—মানবজীবনকে দান করিয়াছে পূর্ণাঙ্গ পথনির্দেশ; খ্রিষ্টধর্মের ষষ্ঠ আদেশ—“তুমি হত্যা করিও না”—মানবজীবনের মর্যাদাকে তুলিয়াছে শীর্ষস্থানে; বৌদ্ধধর্ম মানবজীবনকে ঘোষণা করিয়াছে বিরল সুযোগ হিসেবে, যাহার মাধ্যমে ‘নির্বাণ’ লাভ সম্ভব; হিন্দুধর্ম প্রতিপাদন করিয়াছে পুরুষার্থ চতুষ্টয়—ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ—যাহাই মানবজীবনের সার্থকতা। অথচ আমরা আজ সেই মহৎ বাণীর বিপরীতে চলিয়া মানবজাতিকে বিভাজিত করিতেছি।
তাহা হইলে সমাধান কোথায়? উত্তর সুস্পষ্ট—যেদিন ধর্মকে ক্ষমতা-লোভের হাতিয়ার না করিয়া শান্তি ও ন্যায়ের পবিত্র প্রদীপ বলিয়া ধারণ করা হইবে, সেদিনই বিভেদের অগ্নিশিখা নিবিয়া যাইবে। যেদিন রাষ্ট্রনায়ক ও সমাজনেতা ধর্মের আড়ালে বিদ্বেষ না বপন করিয়া মানবমৈত্রীর বাণী প্রচার করিবেন, সেদিনই প্রতিষ্ঠিত হইবে ভ্রাতৃত্ব। যেদিন প্রতিটি রাষ্ট্র নাগরিককে ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে সমঅধিকার দান করিবে, সেদিনই সত্যিকার শান্তি প্রস্ফুটিত হইবে।
আজ মানবতার সম্মুখে এক মহাগুরুতর প্রশ্ন উপস্থিত—আমরা কি ধর্মের প্রদীপ জ্বালাইয়া রাখিব, না কি তাহা নিভাইয়া বিভেদের অগ্নি প্রজ্বলিত করিব? ইতিহাস সুস্পষ্ট করিয়াই শিক্ষা দিতেছে—অশান্তির কোনো উত্তর নাই, বিভেদের কোনো ভবিষ্যৎ নাই। কেবল ধর্মের প্রকৃত আলোকবাণী ধারণ করিলেই সম্ভব হইবে বিভেদরেখা মুছিয়া ফেলা, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, এবং স্থায়ী শান্তির অঙ্কুরোদ্গম। আর এই ন্যায়পথে, ধর্মচেতনার দীপশিখা হাতে ধারণ করিয়া চলিলেই মিলিবে শান্তি, প্রতিষ্ঠিত হইবে অধিকার, এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হইবে সমগ্র মানবজাতি।
অতএব প্রশ্ন একটিই—শান্তি না হানাহানি, ধরণীতে প্রতিষ্ঠিত হইবে কাহার রাজত্ব? এই ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে আমাদেরই সিদ্ধান্তের উপর। সেই কারণেই পরিসমাপ্তিতে আমার এই অমোঘ আহ্বান—
ধর্ম হউক শান্তির প্রদীপ, নহে বিভেদের অগ্নিশিখা,
মানব হৃদয়ে জ্বলুক ভ্রাতৃত্ব, নয় ঘৃণার দাহিকা।
অধিকার দাও সকলকে, করুণা নয় জীবনের শিরোপা,
ন্যায় ও প্রেমে বাঁধা থাকুক বিশ্ব, হউক শান্তির অনুপম রূপা।
— লেখক: অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), উপদেষ্টা সম্পাদক
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: