
— উপসম্পাদকীয়
জীবন কাহাকে বলে? কাহার জন্য এ অদৃশ্য যাত্রা? মানবের জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ, প্রেম ও ঘৃণার আড়ালে লুকায়িত রহিয়াছে এক অনির্বচনীয় রহস্য। “হোয়াট ইজ লাইফ? জীবন কি? জীবনের লক্ষ্য কি?”—এই প্রশ্ন মানব সভ্যতার আদিকাল হইতে আজিও দার্শনিক মস্তিষ্কমণ্ডলীকে আলোড়িত করিয়া আসিতেছে।
জীবন হচ্ছে, ক্ষণস্থায়ী জগতে মোহের আবেশ। এই পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী; তথাপি মানুষের আসক্তি সীমাহীন। ধন, যশ, ভোগ ও আধিপত্যের মোহে আত্মা বন্দী হইয়া পড়ে। প্রশ্ন জাগিতেই পারে—টিকিয়া থাকাই কি জীবন? যদি কেবল অস্তিত্ব রক্ষাই লক্ষ্য হয়, তবে কি মানব জীবন তেলাপোকার মতো হইয়া যায় না? প্রকৃতি সাক্ষ্য দেয়—অতিকায় ডাইনোসর বিলুপ্ত হইয়াছে, কিন্তু ক্ষুদ্রাকায় তেলাপোকা এখনো টিকিয়া রহিয়াছে! তাহা হইলে কি টিকিয়া থাকাই মানব জীবনের পরম উদ্দেশ্য?
তাইতো জীবনের সমাচারে দ্বিরুক্তির দ্বৈরথ শুনিতে পাওয়া যায় ‘বীরত্বের মহিমা বনাম কাপুরুষতার হাহাকার এর মাঝখানে’।এই যখন অবস্থা তখন মহান টিপু সুলতানের কথা মনে পড়িয়া যায়, শৃগালের ন্যায় এক যুগ বাঁচার চেয়ে সিংহের ন্যায় এক দিন বাঁচা উত্তম।” এই উক্তি মানব জীবনকে পরিমাপ করে অস্তিত্বের দৈর্ঘ্যে নহে, বরং মর্যাদার গভীরতায়। ভীরু ও কাপুরুষোচিত জীবন যাপন করিয়ো দীর্ঘকাল বাঁচিয়া থাকিবার চাইতে সিংহের মতো Brave (সাহসী) ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করিয়া অল্প সময়কাল বাঁচিয়া থাকাও অনেক ভালো। কেননা ধর্মশাস্ত্রে ঘোষণা শুনা যায়,“কাপুরুষ প্রতিদিন মরে।” তাহাদের জীবিত দেহ চলাফেরা করে বটে, কিন্তু প্রাণহীন এক স্পর্শে। যে জীবন সত্য, ন্যায় ও সাহসের পথে আত্মাহুতি দিতে ভয় পায়, তাহা জীবন নহে, জীবনের নামে বেঁচে থাকা কেবল এক জীন্দা লাশমাত্র, প্রাণহীন এক রোবট সদৃশ।
খুঁজিলেই পাওয়া যায় জীবনের অর্থ। তাইতো আমাদের পাণে হাত বাড়াইয়াই রহিয়াছে ঐশী বাণীর দীপ্তি, যাহা জীবনের পথচলাকে আলোকিত করিয়া সার্থকময় করিয়া তোলে।সম্পূর্ণ জীবন বিধান (Complete code of life) রহিয়াছে মানব অক্ষীর সম্মুখে।আল-কোরআন সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করে—মানুষ হইল “আশরাফুল মাখলুকাত”, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম। মানবকে এই ধরাধামে প্রেরণ করা হইয়াছে তাঁহার খলিফারূপে—সত্য, ন্যায় ও দায়িত্বশীলতার বার্তাবাহক হিসেবে। কিন্তু পরিহাস এই, আমাদেরই কর্মকাণ্ডে আমরা হইয়া উঠি পশুর চেয়েও অধম। সত্য অবহেলা করি, দৈববাণী অমান্য করি, স্বার্থের অন্ধকারে মানবতার প্রদীপ নিভাইয়া ফেলিতেও বিন্দুমাত্র চিন্তা করি না।
তাহলে আমরা বলিতেই পারি, জীবন কেবল অস্তিত্ব নহে, উদ্দেশ্যপূর্ণ যাত্রা। জীবন কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসের ধারা নহে; ইহা এক পরীক্ষাক্ষেত্রও বটে। অস্তিত্বের বাইরেও জীবনের অন্তর্লীন উদ্দেশ্য রহিয়াছে। বিজ্ঞান বলে—জীবন অভিযোজনের আরেক নাম; কিন্তু দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা ঘোষণা করে—জীবন এক পরীক্ষা, যেখানে চির যুদ্ধে লিপ্ত ন্যায় ও অন্যায়। তাইতো সত্য ও মিথ্যার এই সংর্ঘষে মানুষকে যেকোনো একপক্ষ বাছিয়া লইতে হয়। আর সঠিক ন্যায়ের পথ যাহার বাছিয়া লইতে পারে, তাহারা কানার হাটবাজারেও দুমূল্য। তবে সবাই কি তাহা পারে? শুধু তাহারাই বিজয়ী হন যিাদের উপর মহান সৃষ্টিকর্তা করুণা করেন। আবার অহংবোধে বোধিপ্রাপ্ত অনেকেই পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী মায়ায় ডুবে যান, যাদের চর্ম চক্ষু সৃষ্টিকর্তা যেন অদৃশ্য শীশার আবরণে ঢেকে দেন।সাময়িক নিজেকে সর্বসর্বা মনে হইলে ানেকের মণেই ব্যাপক পুলক দিয়া উঠিতে পারে, কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, তাহা ক্ষস্থায়ী।
তাহলে জীবন কি?
জীবনের এই মঞ্চ যেন, ন্যায়ের পথে মানুষের পরীক্ষা। ন্যায়নিষ্ঠ মানুষগণ যুগ যুগ ধরেই অধিক কষ্ট ভোগ করিয়া আসিতেছেন, আর ইহাই যেন বিধির বিধান হইয়া দাড়াইয়াছে। আসলেই কি তাই?
আসলে বলিতে গেলে মনে হয় মহান স্রষ্টা যাহাদিগকে ভালোকবাসেন, তাহাদিগের প্রতিই বেশি পরীক্ষা নিয়া থাকেন। যেন তাঁহাদের আনুগত্য ও ধৈর্যের পরীক্ষা তিঁনি গ্রহণ করিয়া সস্তুষ্ট হইয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে এই পৃথিবী নামক রঙমঞ্চে মানবজীবন বহুরূপে প্রকাশিত—কোথাও আলো, কোথাও আঁধার; কোথাও কল্যাণের দ্যুতি, কোথাও অকল্যাণের হাহাকার।
লালনের ভাষায় বলিতে গেলে, “এসব দেখি কানার হাট বাজার। বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা, আর এক কানা মন আমার।। পণ্ডিত কানা অহংকারে, মাতবর কানা চোগলখোরে। সাধু কানা অন বিচারে, আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে, চেনে না সীমানা কার।।” আর এই কানাদের হাটবাজারেই সৃষ্টিকর্তা দিয়াছেন সযত্ন পথ নির্দেশ। কল্যাণের এই দিকনির্দেশনায় জীবনের রূপ হইয়া উঠে আরো বর্ণিল। কল্যাণের সর্বোৎকৃষ্ট রূপ আল-কোরআনে বর্ণিত হইয়াছে। সূরা আলে-ইমরান (আয়াত নং -১১০) এ বলা হইয়াছে, “তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির (সর্বাত্মক কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভুত করা হইয়াছে, তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ হইতে নিষেধ কর ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করিয়া চল। যদি আহলে কিতাব ঈমান আনিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তাহাদের জন্য ভাল হইত, তাহাদের মধ্যে কেউ কেউ মু’মিন এবং তাহাদের অধিকাংশই ফাসেক।”
আসলেই তাই! মানব সমাজে ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব সেই সৃষ্টিকাল হইতেই চলমান রহিয়াছে, আর যাহা চিরকালই চলমান থাকিবে। কেবল সৎ থাকিতে পারাই যথেষ্ট নহে; বরং সক্রিয়ভাবে সৎকাজ প্রচার করিবার এবং অসৎকাজ প্রতিরোধ করিবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। ইহাই উম্মাহর বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণ। কেবল দুনিয়াবি সাফল্য নহে, বরং আখেরাতের মুক্তিও এই জীবনের উপরই নির্ভরশীল। তবে অবুঝ মানব মন অনেকক্ষেত্রেই তাহা বুঝিতে ব্যর্থ হয়। সত্যের অনুসরণে আগমনকৃত ঐশী দিকনির্দেশ প্রত্যাখ্যান করিলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঐশী বাণী থেকে জীবনের মূল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়—“জীবন কেন?”। মানব জীবন কেবল বেঁচে থাকিবার বা ভোগ-বিলাসের করিবার জন্য নহে; বরং ন্যায়ের আদেশ, অসৎকর্ম প্রতিরোধ এবং ঈমানের ভিত্তিতে মানবজাতির কল্যাণ নিশ্চিত করিবার মিশনই জীবন।
তাহা হইলে এ কথা বলা যাইতেই পারে, মানবজীবনের পরম লক্ষ্য হইল সেই ঐশী দিকনির্দেশের অনুসরণ। মানুষ যতদিন পর্যন্ত আল্লাহর ঘরে—অর্থাৎ দয়া, ক্ষমা ও আনুগত্যের ছায়াতলে ফিরিয়া না যায়, ততদিন তাহাদের জীবনের প্রকৃত অর্থ উদ্ঘাটিত হয় না। স্রষ্টার স্মরণই অস্থির মনকে সুস্থির করিবার পরম উপায়। আর তাঁহার প্রিয় হাবীব (সা.)–এর রওজা জিয়ারতের অনুভূতি জীবনের গভীরতম প্রশান্তির উৎস, জীবনের স্বরূপ বুঝিবার অনুপ্রেরণা। কেননা জীবন ঘন্টায় বাজে শান্তি ও অশান্তির দ্বন্দ্ব। পৃথিবীতে শান্তি ও অশান্তি পাশাপাশি বিরাজমান। কেহ মানবকল্যাণে আত্মোৎসর্গ করিয়া ন্যায় প্রতিষ্ঠার মশাল জ্বালাইয়া সামনে যাইবার চেষ্টায় মশগুল, আবার কেহ অশান্তি সৃষ্টি করিয়া নির্মম ক্রুঢ় হাসিতে অস্থির যেন আনন্দে বিহ্বল তার দেহ মন আত্মা। হায়রে মানব জীবন, কেমনে একজন আরেকজনের অসহায়ত্বের দুঃখে আনন্দ উপভোগ করিতে পারে। কিন্তু তাহা কি স্থায়ী? উত্তর আসিবে, না না না।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—অধর্ম, অবিচার ও নিপীড়ন কিছুকাল স্থায়ী হইলেও তাহাদের শেষ পরিণতি সর্বদাই হয় শোচনীয়। মহান রব বারংবার সতর্কবাণী দিয়া গিয়াছেন—অন্যায়ের অবসান অনিবার্য, ন্যায়ই চূড়ান্ত বিজয়ী।
জীবনের পরম প্রশ্ন হচ্ছে, তাহা হইলে জীবন কি? কেবল দুঃখ-কষ্ট সহিষ্ণুতা, মোহ ও মায়ার স্রোতের ভেলায় ভাসিয়া যাওয়াই কি ইহার লক্ষ্য? না কি জীবনের প্রকৃত অর্থ হইল স্রষ্টার আনুগত্য, মানবতার সেবা এবং ন্যায়ের পথে অবিচল যাত্রা? সত্য হইল—মানবজীবনের পরম মানে লুক্কায়িত রহিয়াছে স্রষ্টার নির্দেশিত কল্যাণের কর্মে।
পরিশেষে জীবনের দিকনির্দেশ দেওয়া যাইতে পারে। অতএব জীবনের সমাচার এই শিক্ষা প্রদান করিয়া তৃপ্তি পাইতে থাকেেআসলে বাঁচিয়া থাকাই মুখ্য নহে; বরং কিরূপে বাঁচিয়া থাকা, কী উদ্দেশ্যে এই বাঁচিয়া থাকা—ইহাই পরম তাৎপর্য। মানুষের জীবন মোহের বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া কেবল অস্তিত্বের ন্যক্কারজনক প্রদর্শনী হইতে পারে না। জীবন হইবে সত্য ও ন্যায়ের আলোকবর্তিকা, মানবকল্যাণের পথিকৃৎ, এবং মহান স্রষ্টার নির্দেশে দায়িত্বপূর্ণ এক পবিত্র যাত্রা।
— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: