odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Friday, 12th December 2025, ১২th December ২০২৫
রক্ত, বীরত্ব আর প্রতিরোধের গল্প—একাত্তরের ১২ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জবাসীর স্বাধীন দেশে প্রথম ভোরের ইতিহাস

আজ ১২ ডিসেম্বর—স্বাধীনতার প্রথম ভোর দেখেছিল মুন্সীগঞ্জ।

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ১২ December ২০২৫ ২০:২৮

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ১২ December ২০২৫ ২০:২৮

—উপসম্পাদকীয়

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর—মুন্সীগঞ্জ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন দেশের প্রথম ভোর। রক্তঝরা যুদ্ধ, হরগঙ্গা কলেজের লড়াই, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও বিজয়ের আনন্দে ভেজা এক ঐতিহাসিক জনপদের স্মরণগাথা।

শীতের কুয়াশা ভেজা ভোরগুলো সাধারণত নীরবই থাকে। নদীর জল তখন ধূসর, গাছের পাতায় জমে থাকে শিশির, আর মানুষ ধীরে ধীরে জেগে ওঠে দিনের কাজে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বরের ভোর ছিল একেবারেই অন্যরকম। সে ভোরে কুয়াশার আড়াল ভেদ করে মুন্সীগঞ্জের আকাশে উঁকি দিয়েছিল এক নতুন সূর্য—স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। দীর্ঘ নয় মাসের ভয়, ক্ষুধা, বারুদের গন্ধ আর মৃত্যুর ছায়া পেরিয়ে এই প্রথম মুন্সীগঞ্জবাসী স্বাধীন দেশের বাতাসে গভীর নিশ্বাস নিতে পেরেছিল।

একাত্তরের মুন্সীগঞ্জ ছিল রণকৌশল আর বীরত্বের এক অনন্য ময়দান। ঢাকা শহরের নিকটবর্তী হওয়ায় বিক্রমপুর অঞ্চলের এই জনপদটি কৌশলগতভাবে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেঘনা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার জলে ঘেরা এই নদীমাতৃক ভূখণ্ডে যে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে উঠেছিল, তা কেবল বন্দুক আর গ্রেনেডের লড়াই ছিল না—এ ছিল নদী ও মাটির লড়াই, মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।

২৫ মার্চের কালরাত্রির পর থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক থাবা নেমে আসে মুন্সীগঞ্জে। শহরের সরকারি হরগঙ্গা কলেজ হয়ে ওঠে তাদের প্রধান শক্ত ঘাঁটি। সেখান থেকেই তারা নিয়ন্ত্রণ করত পুরো বিক্রমপুর অঞ্চল। দিনের পর দিন চলেছে হত্যা, লুণ্ঠন আর অগ্নিসংযোগ। ধলেশ্বরী আর মেঘনার জল লাল হয়ে উঠেছিল নিরীহ মানুষের রক্তে। কাটাখালী, গজারিয়া—একটির পর একটি গণহত্যা এই জনপদকে রক্তাক্ত করেছে। ৯ মে গজারিয়ার দশটি গ্রামে চালানো হত্যাযজ্ঞে ৩৬০ জন নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়—যে স্মৃতি আজও এই মাটিকে ভারী করে রাখে।

কিন্তু বাঙালি দমে থাকার জাতি নয়। মুন্সীগঞ্জেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ছাত্র, যুবক, আনসার, পুলিশ—সবাই মিলে গড়ে তোলে প্রতিরোধ। ধলেশ্বরীর তীরের দামাল ছেলেরা প্রস্তুত হতে থাকে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। টংগিবাড়ী, লৌহজং, সিরাজদিখানসহ জেলার নানা প্রান্তে মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক সফল অপারেশন চালিয়ে শত্রুকে পিছু হটাতে থাকে। ১৪ নভেম্বর টংগিবাড়ী উপজেলা শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর যখন বিবিসিতে প্রচারিত হয়, তখন পাকিস্তানি বাহিনীর ভিত কেঁপে ওঠে।

শুনুন গানে গানে মুন্সিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ / 1971 এর মহান মুক্তিযুদ্ধে মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের বীরত্বগাথার গান

ডিসেম্বরের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে হানাদাররা। বিশেষ করে শহর মুন্সীগঞ্জ ও সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ঘিরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণ তাদের মনোবল ভেঙে দেয়। ১০ ডিসেম্বর রাতভর অবিরাম ফায়ারিং আর গ্রেনেড বিস্ফোরণে পাকিস্তানি বাহিনী ভেবে বসে, চারদিক থেকে বিশাল বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলেছে। বাস্তবে তা ছিল পরিকল্পিত গেরিলা কৌশল—পেছনের জঙ্গল, নদীর পাড় আর আশপাশের দালান ব্যবহার করে শত্রুকে বিভ্রান্ত করার এক অসাধারণ রণকৌশল।

ভোরের আলো ফোটার আগেই, ১১ ডিসেম্বর খুব সকালে, হানাদাররা বুঝে নেয়—এই মাটিতে তাদের আর কোনো স্থান নেই। তারা হরগঙ্গা কলেজসহ বিভিন্ন ক্যাম্প গুটিয়ে লঞ্চ ও কার্গো বোঝাই করে শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীপথে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় ধ্বংস করে দিয়ে যায় ধলেশ্বরীর তীরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। শহরের রাজপথ তখনো জানত না—একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়ের অবসান ঘটে গেছে।

১১ ও ১২ ডিসেম্বর—এই দুই দিন মুন্সীগঞ্জের ইতিহাসে একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। হানাদারদের পলায়নের খবরটি বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পড়তেই প্রথমে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল, তারপর আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে শহরে প্রবেশ করতে থাকেন। হাজারো মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে তাদের স্বাগত জানাতে। যারা নয় মাস ঘরছাড়া ছিল, তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে ফিরতে শুরু করে। হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পে গিয়ে মানুষ দেখে কংকাল আর রক্তের দাগ—স্বাধীনতার ভয়াবহ মূল্য।

আরো পড়ুন: ধলেশ্বরীর ঢেউয়ে প্রতিরোধের গান—৭১-এর মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের রণাঙ্গনের বীরত্বগাথা ধলেশ্বরী থেকে টংগিবাড়ী, গজারিয়া থেকে হরগঙ্গা কলেজ— প্রতিটি নদী, প্রতিটি চর, প্রতিটি মাটির ঢেলা সাক্ষী এক অবিনশ্বর ইতিহাসের। সব মিলিয়ে এটি এক সত্যিকারের নদী ও মাটির লড়াই। পুরো ফিচারটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সেদিন দুপুরে পুরোনো কাচারি চত্বর ও হরগঙ্গা কলেজ প্রাঙ্গণে ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে একটাই স্লোগানে—“জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।” স্বজন হারানোর কান্না আর স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেই মুহূর্তে।

এর পরের ভোর—১২ ডিসেম্বর। স্বাধীন দেশে মুন্সীগঞ্জবাসীর প্রথম ভোর। সে ভোরে কোনো বন্দুকের আওয়াজ ছিল না, ছিল না কারফিউয়ের আতঙ্ক। ছিল কেবল এক নতুন দিনের আলো, নতুন স্বপ্নের শুরু।

আজও প্রতি বছর ১১ ডিসেম্বর শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়, আলোচনা সভা হয়, র‍্যালিতে মুখর হয় শহর। আর ১২ ডিসেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি। এর পেছনে আছে হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ, মা-বোনের সম্ভ্রম আর মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় সাহস।

মুন্সীগঞ্জের মাটি কেবল অতীশ দীপঙ্করের জ্ঞান আর জগদীশ চন্দ্র বসুর বিজ্ঞানের জন্য নয়—এ মাটি বীরের মাটি। একাত্তরের সেই রক্তঝরা দিন পেরিয়ে আজও এই জনপদ নতুন প্রজন্মকে শেখায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে জয় অনিবার্য। আজ ১২ ডিসেম্বর, সেই শিক্ষা আর সেই গর্ব বুকে ধারণ করেই মুন্সীগঞ্জবাসী নতুন দিনের পথে এগিয়ে চলে—স্বাধীনতার প্রথম ভোরের আলোকে সঙ্গী করে।

অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

#১২ডিসেম্বর #মুন্সীগঞ্জমুক্তদিবস #একাত্তর #মুক্তিযুদ্ধ১৯৭১ #বিক্রমপুর #হরগঙ্গাকলেজ #নদীওমাটিরলড়াই #মুক্তিযোদ্ধা #জয়বাংলা #স্বাধীনতারইতিহাস #বাংলাদেশেরইতিহাস #রক্তঝরাএকাত্তর #মুন্সীগঞ্জ #BangladeshLiberationWar #Dec12 #MunshiganjLiberation



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: